কক্সবাজারে শক্ত অবস্থানে বিএনপি
নবীন প্রার্থী প্রাধান্য দিয়ে মাঠে জামায়াত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের ৪টি সংসদীয় আসনের সর্বত্রই চলছে ভোটের আলোচনা। বিশেষ করে বিএনপির দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর মধ্যে সদ্য প্রকাশিত হয়েছে নতুন ভোটার তালিকা। নতুন তালিকা অনুযায়ী এবার জেলার চারটি আসনে মোট ভোটার ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৭ জন। এর আগের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৯৬০ জন। সে হিসেবে ভোটার বেড়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯৭ জন।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারের চারটি আসনেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। তবে এবার জামায়াত আগে থেকে প্রার্থী ঘোষণা করে ভোটারদের মন জয় করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চারটি আসনের তিনটিতেই নবীন প্রার্থী দিয়েছে দলটি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত, সীমান্ত বাণিজ্য, গভীর সমুদ্রবন্দর, সোনা দিয়া, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, বিশ্বের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রসহ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার। এসব কারণে এখানকার চারটি সংসদীয় আসনই গুরুত্বপূর্ণ। আগামীর সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হবে কক্সবাজার। ফলে দলগুলো সেই গুরুত্ব বিবেচনা করেই নির্বাচন পরিচালনা করছে। চার আসনের মধ্যে তিনটি আসনে বিএনপি তাদের পুরনো প্রার্থীদের ওপর আস্থা রেখেছে। আর জামায়াত নতুন মুখ নিয়ে এসেছে ভোটারদের সামনে।
কক্সবাজার ১ : জাতীয় সংসদের ২৯৪ নম্বর আসনটি কক্সবাজার জেলার প্রবেশ দার চকরিয়া পেকুয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসনে এবার ভোটার ৫ লাখ ৪০ হাজার ৪৬৮ জন। আসনটিতে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির এ এইচ সালাউদ্দিন মাহমুদ, ১৯৯১ সালে জামায়াতের এনামুল হক মঞ্জু, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ, ২০০৮ সালে সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ, ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ ইলিয়াস, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের জাফর আলম এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ আসনের এবারের বিএনপির প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমদ আগে তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এই আসনে বিএনপি থেকে সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাছিনা আহমেদ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপিকে পরাজিত করেন তিনি। হাছিনা পান এক লাখ ৫৬ হাজার ৫১২ ভোট। আর সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপির পেয়েছেন এক লাখ ২১ হাজার ১১১ ভোট। এবার গুরুত্বপূর্ণ এ আসনটিতে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদের বিপরীতে জামায়াত প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ফারুক ভোটের মাঠে নবীন।
তথ্যমতে, আবদুল্লাহ আল ফারুক ছাত্রজীবনে শিবিরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার শহর জামায়াতের আমির। এবারই প্রথম তিনি জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ফলে বিএনপির সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে জামায়াতের আল ফারুক কতটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন- এ নিয়েই আলোচনা চলছে। এ ছাড়া এই আসনে এবি পার্টির অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান, জাতীয় পার্টির শামসুল আলম, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মনির উল্লাহ, জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, গণ অধিকার পরিষদের আব্দুল কাদের প্রাইম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা সরওয়ার আলম প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চকরিয়া পেকুয়া আমার নিজের এলাকা। আমাকে যখন গুম করা হয়, তখন দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ রোজা রেখে প্রার্থনা করেছিল। আমি চকোরিয়া পেকুয়ার পাশাপাশি কক্সবাজার জেলাজুড়ে অনেক উন্নয়ন করেছি। সরকারি চাকরি ছেড়ে এলাকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি। চকরিয়া পেকুয়ার পাশাপাশি পুরো দেশকে জাতীয়তাবাদী শক্তিতে বলিয়ান করে একটি সুন্দর অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছি। আমি মনে করি এদেশের তরুণ প্রজন্ম বদলে দেবে আগামীর বাংলাদেশ।
কক্সবাজার ২ : আসনটি কক্সবাজারের দুটি দ্বীপ মহেশখালী এবং কুতুবদিয়া নিয়ে গঠিত। এ আসনে এবার ভোটার ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪০ জন। আসনটি ফাঁকা রেখেছে বিএনপি। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাঠে কাজ করতে বলেছেন জানিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ প্রচার চালাচ্ছেন। এ আসনে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির জহিরুল ইসলাম, ১৯৮৮ সালেও জাতীয় পার্টির জহিরুল ইসলাম, ১৯৯১ সালে বাকশালের মোহাম্মদ ইসহাক বিএ, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির এটিএম নুরুল বশর চৌধুরী, ১৯৯৬-এর জুনে ও ২০০১ সালে বিএনপির আলমগীর মো. মাহফুজুল্লাহ ফরিদ, ২০০৮ সালে জামায়াতের ড. এইচএম হামিদুর রহমান আযাদ, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের আশেক উল্লাহ রফিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এ আসনে রয়েছে মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দর, ধলঘাটা অর্থনৈতিক অঞ্চল, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়া দ্বীপের মতো প্রাকৃতিক সুন্দর দ্বীপ এবং বিশাল বঙ্গোপসাগর। এদিকে দৃষ্টি রয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর। ফলে এই আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এসব কারণেই বিএনপি আসনটি ফাঁকা রেখেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, জোটগত কারণে শরিকদের দেওয়ার জন্য ফাঁকা রেখেছে। তবে কক্সবাজার জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী বলেন, আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ ছাড়াও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর মো. মাহফুজুল্লাহ ফরিদ, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা সুজাউদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অধ্যক্ষ মাওলানা জিয়াউল হক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কক্সবাজার ৩ : সদর, রামু ও ঈদগাঁও উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ সংসদীয় আসনে এবারে ভোটার ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৩৫ জন। আসনটিতে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ও ১৯৯৬ সালের জুনে বিএনপি অ্যাডভোকেট খালেকুজ্জামান, ২০০১ সালে বিএনপির প্রকৌশল মো. শহিদুজ্জামান, ২০১৮ সালে বিএনপি লুৎফুর রহমান কাজল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সব মিলিয়ে ৪ বার বিএনপির দখলে থাকা আসনটিতে এবার দলের প্রার্থী কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফুর রহমান কাজল। এ আসনের ভোটের মাঠে দক্ষ প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন মাঠে তৎপর রয়েছেন তিনি। তার বিপরীতে জামায়াতের প্রার্থী শহিদুল আলম বাহাদুর। তিনি একবার কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে এবার প্রথম। এক সময়ের ছাত্র শিবিরের হয়ে কলেজের ভিপি নির্বাচিত হওয়া জামায়াতের এই প্রার্থী বিএনপির প্রার্থীকে কতটা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন- এটাই এখন আলোচনার বিষয়। এ ছাড়া এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুহাদ্দিস আমিরুল ইসলাম প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বিএনপির প্রার্থী লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, এটি বিএনপির আসন হিসেবেই পরিচিত। প্রচারণায় মানুষের ব্যাপক ছাড়া পাচ্ছি। আমরা মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। এ আসনে বিএনপিই বিজয়ী হবে।
কক্সবাজার ৪ : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের উপজেলা টেকনাফ, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বিশ্বের প্রধান শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্র উখিয়া নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৯৭ নম্বর আসন। এ আসনে এবার ভোটার ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৩ জন। আসনটিতে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী, ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, ২০০১ সালে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের আব্দুর রহমান বদি, ২০১৪ সালে আব্দুর রহমান বদি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনসহ তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন শাহজাহান চৌধুরী। জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ ও জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী এবারও বিএনপির প্রার্থী। আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন নুর আহমদ আনোয়ারী। তিনি জেলা জামায়াতের আমির। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী আসনটিতে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে জয়ী হতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
সাকিবকে নিয়ে যা বললেন ওবায়দুল কাদের
এদিকে এ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য জেলা বিএনপির নেতা মো. আব্দুল্লাহর সমর্থকরা টেকনাফে মশাল মিছিল ও কাফনের কাপড় পরে প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরবর্তী সময় মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সামাজিক মাধ্যমে দলের ও ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। আসনটিতে রয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। যেখানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। ফলে নানাভাবে আলোচিত এই আসনটি। এখানে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বিএনপির প্রার্থী শাজাহান চৌধুরী বলেন, প্রচারে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। মানুষ যে বিএনপিকে ভালোবাসে তা আবার প্রমাণ করবে ধানের শীষকে এই আসনে বিজয়ী করে। বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও এ আসনে এবি পার্টির শামসুল হক সারেক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা নুরুল হক নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।