আগামী নির্বাচন এবং ড. ইউনূসের চ্যালেঞ্জসমূহ

সাঈদ বারী
১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২৮
শেয়ার :
আগামী নির্বাচন এবং ড. ইউনূসের চ্যালেঞ্জসমূহ

আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ যেন এক অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। এই পরীক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাপী সফল সামাজিক উদ্যোক্তা ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষ যা চাইছে- একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন- তা এখন কেবল প্রত্যাশা নয়, বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে শুধু ভোটের ফলাফল নয়, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, জনগণের আস্থা এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাকে বিশেষ অবস্থানে রাখে। বিশ্বের কাছে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও সমাজ সংস্কারক; দেশের মানুষের কাছে তিনি ন্যায়, সততা ও নৈতিকতার প্রতীক। কিন্তু এই প্রতীককে কার্যকরভাবে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে শুধু রাজনৈতিক স্বীকৃতি নয়; নির্ভর করছে তার নাম ইতিহাসে নায়ক হিসেবে লেখা হবে কি না। ব্যর্থ হলে তা কেবল নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে স্থায়ী ক্ষতি ঘটাবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখিয়েছে, নির্বাচন কখনও কেবল ভোটের সংখ্যা নির্ধারণের বিষয় নয়। এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরীক্ষা। দেড় দশক ধরে দেখা গেছে প্রশাসনের প্রভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনের সীমিত সক্ষমতা এবং সহিংসতা কতটা নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে, ড. ইউনূসের দায়িত্ব দ্বিগুণ। তার নেতৃত্বে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়, তা শুধু ভোটের ফলাফলের বিষয় হবে না; তা হবে দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পুনর্গঠনের সূচনা।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়ানুবর্তিতা। পূর্বঘোষিত নির্বাচনের সময়সূচি অনুযায়ী তফসিল ঘোষণা করা একান্ত অপরিহার্য। সময় বিলম্ব বা অনিশ্চয়তা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াবে, জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন করবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মনে সংশয় জাগাবে। এক মুহূর্তও বিলম্ব হলে নির্বাচন স্বচ্ছতার বদলে বিতর্ক ও অবিশ্বাসের দিকে ধাবিত হবে।

নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু করতে যা প্রয়োজন তা বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং মাঠপর্যায় পর্যন্ত নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা- এসব একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেন সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে মুক্ত থাকে, নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ পায় এবং ভোটারদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হয়- এসবই ড. ইউনূসের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত।

নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সহিংসতা, প্ররোচনা বা প্রভাবশালী হস্তক্ষেপ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও দক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই সমন্বয় ছাড়া ভোটারদের ভোটাধিকার রক্ষায় সফল হওয়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগোষ্ঠী ড. ইউনূসের প্রতি নিবিড় দৃষ্টি রাখছে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের সঙ্গে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সরাসরি যুক্ত। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য, স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। ব্যর্থ হলে তা দেশের খ্যাতি ও সরকারের মর্যাদার জন্য ভয়াবহ ফল বয়ে আনবে।

নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতিতে নজর দিতে হবে ভোটার তালিকার সঠিকতা, প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই, মিডিয়ার স্বাধীনতা এবং প্রচারণায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনো প্রার্থী প্রশাসনের সুবিধা ব্যবহার করে ভোট প্রভাবিত করতে পারে; এই বাস্তবতার মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়।

ড. ইউনূসের অগ্নিপরীক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ। নির্বাচনকালে যে কোনো অনিয়ম, প্রভাব বা সহিংসতা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সরাসরি নজরে রাখবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তিনি শুধু দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সমর্থকের বিশ্বাসও পুনঃস্থাপন করতে পারবেন।

নির্বাচনের সাফল্য শুধু সরকারের নয়, পুরো দেশের স্বার্থে জরুরি। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি এবং যুব সমাজের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে। নির্বাচনী ত্রুটিমুক্তি নিশ্চিত হলে রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও কর্মসূচি স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়া ড. ইউনূসের দায়িত্ব বহুমাত্রিক। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজন করতে হলে এক মুহূর্তও সময় অপচয় করা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমান সুযোগ প্রদান, প্রশাসনকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত দক্ষভাবে প্রস্তুত করা, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া- এসবই তার প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। নির্বাচনের সাফল্য তার নাম ইতিহাসে একজন নায়ক হিসেবে লিখবে; ব্যর্থতা তাকে কেবল প্রতিনায়ক হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখবে।

এই নির্বাচন শুধু ভোটের সংখ্যা বা জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক আস্থা এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন। নির্বাচনের প্রতিটি ধাপই ইতিহাসে এক ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থায়ী হবে। দেশের স্বার্থে, জনগণের আস্থার জন্য এবং নিজের নেতৃত্বের মর্যাদার জন্য এই চ্যালেঞ্জ পার হওয়া অপরিহার্য।

ড. ইউনূসের অগ্নিপরীক্ষা শুধু রাজনৈতিক নয়; এটি ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতার পরীক্ষা। একসঙ্গে সমন্বয়, স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সময়ানুবর্তিতা ছাড়া এই পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব নয়। দেশের জনগণ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার প্রতি নজর রাখছে। এই অগ্নিপরীক্ষা পার হলে তিনি শুধু একজন নির্বাচনী আয়োজনকর্তা নন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবেও ইতিহাসে থাকবেন।


সাঈদ বারী : প্রকাশক ও কলাম লেখক

মতামত লেখকের নিজস্ব