ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি

ডা. মো. তালহা চৌধুরী
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৯
শেয়ার :
ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি

ডেঙ্গু এক ধরনের ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। সাধারণত ভোর ও বিকালের দিকে এই মশা বেশি সক্রিয় থাকে। এডিস মশা জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে; যেমন ফুলের টব, বালতি, কুলারের পানি, অব্যবহৃত পাত্র, ছাদের কোণে জমে থাকা পানি বা নর্দমার পাশের পরিত্যক্ত পাত্র। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন- DEN-1, DEN-2, DEN-3-৩ এবং DEN-4। একজন মানুষ একবার একটি টাইপের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেই টাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হয়। তবে অন্য টাইপে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সংক্রমণ আগের তুলনায় আরও গুরুতর হতে দেখা যায়।

ডেঙ্গু তিনটি পর্যায়ে দেখা দেয়। প্রথম পর্যায় হলো- ফেব্রাইল ফেজ, যেখানে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উচ্চ জ্বর স্থায়ীভাবে থাকে। মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, সংক্রমণে হাড়ভাঙা অনুভূতি, বমিভাব, অরুচি, শরীরের দুর্বলতা ইত্যাদি সাধারণ লক্ষণ। এ ধাপ দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হতে পারে। দ্বিতীয় ধাপ ক্রিটিক্যাল ফেজ, যা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এ সময় জ্বর কমে গেলেও রোগীর অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটতে পারে রক্তক্ষরণ, তীব্র পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ কমে যাওয়া বা শরীরে প্লাজমা লিকেজ দেখা দিলে শকের ঝুঁকি তৈরি হয়, যা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হিসেবে পরিচিত। এই ধাপ ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে জীবনহানির ঝুঁকি থাকে। তৃতীয় ধাপ হলো রিকভারি ফেজ, যেখানে ধীরে ধীরে রোগী শক্তি ফিরে পায়, ক্ষুধা বাড়ে, প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং প্লাটিলেট সংখ্যা বাড়তে থাকে।

রোগ নির্ণয়ে কিছু পরীক্ষা রয়েছে এবং ডাক্তারের পরামর্শে তা করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর সঠিক খাবার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকালে ওটস, পায়েস, স্যুপ, একটি কলা বা আপেল এবং ডাবের পানি উপকারী। দুপুরে নরম ভাত, ডাল, সিদ্ধ সবজি, রুই বা তেলাপিয়া মাছের মতো নরম মাছ এবং ঝোলজাতীয় খাবার ভালো। বিকেলে পেঁপে, কমলার রস, ওরস্যালাইন বা ঘরোয়া লবণ-চিনি পানি দেওয়া যেতে পারে। রাতে হালকা খিঁচুড়ি, স্যুপ এবং সিদ্ধ সবজি রোগীর পরিপাকে সহায়ক হয়। তেলেভাজা, অতিরিক্ত ঝাল খাবার, কোমল পানীয়, কফি, কোলা, অতিরিক্ত লবণ-চিনি এবং পেট খারাপ থাকলে দুধ বা ভারী দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি প্রাপ্তবয়স্কের প্রতিদিন অন্তত ৩-৪ লিটার ও শিশুর ক্ষেত্রে ওজন অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় ৫-১০ মিলিলিটার/কেজি তরল চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া উচিত। চিকিৎসাব্যবস্থায় কিছু বিশেষ নির্দেশনা মানা বাধ্যতামূলক। জ্বর কমাতে শুধু প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে; ইবুপ্রোফেন বা এ ধরনের অন্য কোনো ব্যথানাশক ব্যবহার করা উচিত নয়। নাক, মুখ, মলদ্বার থেকে রক্ত পড়া, ত্বকে লাল দাগ, অতিরিক্ত দুর্বলতা, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা পেট ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। রক্তচাপ কমে যাওয়া বা শকের লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। নিজে থেকে কোনো ইনজেকশন বা ওষুধ ব্যবহার করা বিপজ্জনক। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সর্বশেষ কথা হলো, জ্বরের প্রথম তিন দিনে NS1 পরীক্ষা, চার দিন পর IgM/IgG পরীক্ষা, প্রতিদিন CBC পর্যবেক্ষণ, পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ, শুধু প্যারাসিটামল ব্যবহার এবং বিপদ সংকেত দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি এগুলোই সঠিক ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়।

লেখক : কনসালট্যান্ট, ফ্যামিলি মেডিসিন, আলোক হেলথকেয়ার

মিরপুর-১০, ঢাকা। ১০৬৭২, ০৯৬১০১০০৯৯৯