বিজ্ঞানে মারজানার কৃতিত্ব
গবেষণায় জাতিসংঘের স্বীকৃতি
গবেষণায় জাতিসংঘের পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশি গবেষক মারজানা আক্তার। সম্প্রতি জাতিসংঘের মর্যাদাপূর্ণ ‘ইয়াং উইমেন ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপ ২০২৫’ প্রোগ্রামে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ এই গবেষক। বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্য থেকে মাত্র ১০ জন গবেষক নির্বাচিত হয়েছেন এই ফেলোশিপে- তাদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি মারজানা। এটি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের নারী বিজ্ঞানীদের সক্ষমতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তার এই অর্জনের গল্প এককথায় নারীদের অনুপ্রেরণার প্রতীক। জীবনের চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়া এই নারী এখন বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের গর্ব।
শৈশবে ছোট শহরে বেড়ে ওঠা মারজানা ছিলেন অদম্য কৌতূহলী। স্কুলের জীববিজ্ঞান ক্লাসে প্রথমবার মাইক্রোস্কোপে কোষ দেখেই যেন তার জীবনের দিক নির্ধারিত হয়। কাচের স্লাইডের নিচে লুকানো জীবন্ত জগতের রহস্য তাকে টেনে নেয় বিজ্ঞানের জগতে। সেখানেই প্রথম উপলব্ধি করেন, প্রতিটি প্রোটিন, জিন, এনজাইম একেকটি গল্প বলে। এই গল্প বুঝতে হলে ল্যাবই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সেই ভাবনা থেকেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন শুরু করেন। এখানে জীবাণু, ভাইরাস ও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পান মারজানা। সেই থেকেই শুরু তার গবেষণার পথচলা, যা একদিন তাকে পৌঁছে দেবে জাতিসংঘের বৈশ্বিক মঞ্চে- তখন হয়তো তিনি নিজেও ভাবেননি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর গবেষণার প্রতি গভীর টান তাকে নিয়ে যায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতকোত্তর পড়তে। এখানেই তিনি জীবাণু ও ভাইরাস নিয়ে গবেষণার দুনিয়ায় সরাসরি কাজের সুযোগ পান। গবেষণায় তার কাজ ছিল ব্যতিক্রমী। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পোলট্রিতে Chicken Infectious Anemia Virus (CIAV) শনাক্ত করেন তিনি, বাংলাদেশের ভাইরোলজি গবেষণায় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই ভাইরোলজি গবেষণায় এটি এক যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ই তিনি সন্তানসম্ভবা হন। একদিকে ল্যাবের কাজ, ক্লাস ও থিসিস লেখা, অন্যদিকে শারীরিক দুর্বলতা- সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে তাকে। গর্ভাবস্থার ছয় মাসে গুরুতর শ্বাসকষ্টে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয় মারজানাকে। পাঁচটি ভয়াবহ দিন কাটলেও তিনি মনোবল হারাননি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘সুস্থ হয়ে আমার থিসিস শেষ করব।’ সন্তান জন্মের পরও সেই প্রতিজ্ঞা পূরণে অটল থেকেছেন তিনি। অসুস্থ শরীর নিয়েও থিসিস ডিফেন্ড করেছেন দৃঢ় মনোবল ও অসীম সাহসে। আর এই পুরো সময়ে মারজানার পাশে ছিল তার পরিবার। আরও পাশে পেয়েছেন তার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক গোলজার হোসেন ও জীবনসঙ্গী ইউশা আরাফকে। মারজানা বলেন, ‘স্যার সব সময় বলতেন, নিজের গতিতে এগিয়ে চলো। নিজের ওপর যখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম, সেই মুহূর্তেই স্যার আবার আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে দিতেন।’ আর স্বামী ইউশা তখন নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে পিএইচডি করছিলেন। দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন ফোনে পরামর্শ ও সাহস দিতেন আমাকে। তিনিই প্রথম আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন বায়োসিকিউরিটি ও বায়োলজিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশনের সঙ্গে। জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো তাকে আরও দৃঢ় করেছে। একবার জাপানের সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে তার ল্যাব নির্বাচিত হলেও আইসিইউতে থাকায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু হতাশ না হয়ে তিনি এটিকে শিক্ষা হিসেবে নেন। তিনি মনে করেন- ‘প্রতিটি না পাওয়া আসলে পরবর্তী সাফল্যের প্রস্তুতি।’ অবশেষে আসে সেই কাক্সিক্ষত সকাল- ই-মেইলে জাতিসংঘের বার্তা, ‘Congratulations! You have been selected...’। প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না মারজানার। বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১০ জনের মধ্যে একজন তিনি! এই অর্জনকে মারজানা কেবল নিজের সাফল্য নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে দেখেন। তিনি চান, বাংলাদেশের তরুণ গবেষকরা যেন বৈশ্বিক গবেষণায় আরও বেশি অংশ নিতে পারেন। দেশে এমন ল্যাব গড়ে উঠুক, যেখানে নারী গবেষকরা নিরাপদ পরিবেশে নতুন আবিষ্কারে কাজ করতে পারবেন। বর্তমানে মারজানার গবেষণার মূল বিষয় বায়োসিকিউরিটি, যেখানে জীববিজ্ঞানের জ্ঞানকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানো, জীবাণু নিয়ন্ত্রণ এবং ল্যাব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মূল লক্ষ্য। তার বিশ্বাস, ‘বাংলাদেশের মেয়েরাও গবেষণায় বিশ্বমানের অবদান রাখতে পারেন, যদি পান সঠিক দিকনির্দেশনা, আত্মবিশ্বাস ও প্রয়োজনীয় সহায়তা।’ মারজানা শুধু একজন গবেষক নন, তিনি একজন মা, একজন যোদ্ধা এবং এক অনুপ্রেরণার নাম। ডিসেম্বর মাসে তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত ফেলোশিপের সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন।
বর্তমানে তার গবেষণার মূল বিষয় বায়োসিকিউরিটি- যেখানে জীববিজ্ঞানের জ্ঞানকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানো, জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও ল্যাব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মূল লক্ষ্য। তার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মেয়েরাও গবেষণায় বিশ্বমঞ্চে সমানভাবে সফল হতে পারেন, যদি পান সঠিক দিকনির্দেশনা ও আস্থা।
মারজানা আজ ৯টি গবেষণাপত্রের লেখক। আজ তিনি একজন মা, একজন গবেষক এবং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নারী। মেয়ে আনাইজার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন নতুন শক্তি পান। মারজানার একটাই চাওয়া- ‘একদিন আমার মেয়ে গর্ব করে বলুক, আমার মা কখনও হাল ছাড়েনি।’
আরও পড়ুন:
যে গ্রহে হয় বালুবৃষ্টি