সুফিয়া কামালের কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি
কবি সুফিয়া কামাল এমন এক বৈরী পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, যখন মুসলমান মেয়েদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল সুদূরপরাহত। এমনকি বাড়ির বাইরে বের হতেও নানা বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরোতে হতো। নিজের অদম্য আগ্রহে মায়ের কাছে তিনি বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। পরে বারো বছর বয়সে বিয়ে হলে স্বামীর আগ্রহ ও উৎসাহে সাহিত্যপাঠ ও অন্যান্য লেখাপড়ার দুয়ার খুলে যায় তার। মাত্র পনেরো বছর বয়সে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের দশ বছরের মাথায় স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন মারা গেলে সুফিয়া কামালের জীবন ঢেকে যায় বিষাদের কালো ছায়ায়। তবে কাব্যচর্চা ও শিল্পের আশ্রয়ে তিনি অতিক্রম করে যান নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের যন্ত্রণাময় সময়। বিরহ ও স্মৃতিকাতরতা তার এই সময়ের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
সুফিয়া কামালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। এ গ্রন্থের ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভগ্নহৃদয়ের গভীর অনুরণন দেখা যায়। সেখানে বসন্ত কবিহৃদয়ে কোনো আনন্দ বয়ে আনে না; শীতের বিষণ্নতা কবিকে আচ্ছন্ন করে রাখে- ‘হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?/ কহিলাম : উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?/কহিল সে কাছে সরে আসি:/কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী/গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে/রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনোমতে।’ (তাহারেই পড়ে মনে, সাঁঝের মায়া)।
সুখের কথা হলো, স্মৃতিকাতরতা এবং বিচ্ছেদ-বেদনা কবিকে অবদমিত না করে সৃষ্টিশীল করে তুলেছিল; তার অন্তহীন যন্ত্রণাকে গভীরতা দিয়েছিল। প্রিয় মানুষের জন্য এই বেদনা, এই প্রেম কবি আজীবন লালন করেছেন তার আপন ভুবনে, মনের গহনে। অতল সেই প্রেমকে কবি অন্তর দিয়ে স্পর্শ করেছেন। এই প্রেম শুধু অনুভব করা যায়, এর ধ্বনি শুধু হৃদয়ে ধারণ করা যায়- ‘তুমি বেঁচে রবে আমার ভুবনে যতদিন আমি রব,/যুগ যুগ ধরি প্রতিদিন আমি তোমারে ঘেরিয়া নব/রচিব মোহন মধুমিলনের বিরহব্যথার গান;/নিখিল বিশ্বে আন ভুবনের যত ব্যথাতুর প্রাণ।’ (তুমি আর আমি, সাঁঝের মায়া)
কবি সুফিয়া কামাল নিজ জীবনের বিষাদময়তাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছেন। এবং পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত নারীর মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। তার এই কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারীর আত্ম-উন্নয়নে বেগম রোকেয়ার অবদানকে তিনি অকুণ্ঠভাবে স্মরণ করেছেন- ‘যে আনিল এই আলো, প্রভাত, ঊষসী/তুমি মাতা-কন্যা-জায়া, নিত্য স্মরণীয়া মহীয়সী।/তাঁহারে স্মরণ করি আমাদের অন্ধকার ঘরে/যে দানিল আলো, মুঠি ভরে।’ (অনন্যা সে নারী, প্রশস্তি ও প্রার্থনা)
আরও পড়ুন:
তাপমাত্রা যখন সর্বনিম্ন!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী চিরকালই অবহেলিত। পরিবার ও সমাজে নারীর যে অবদান, তার স্বীকৃতি মেলে না। অথচ নারী তার আপন গৌরবে, রজনীগন্ধার সুবাস ছড়িয়ে পরিবারের সবাইকে সুখী করে যায়- ‘সম্রাজ্ঞী সে আপন গৌরবে/রজনীগন্ধার মতো পেলব সৌরভে/নরেরে আপন করি লয়।/মমতার মধুভরা নারীর হৃদয়/চিরদিন, সর্বযুগে নারী মহীয়সী/-প্রাণের আলোকে জ্বালি এ বিশ্বরে তুলিছে উদ্ভাসি।’ (নারী ও ধরিত্রী, দেওয়ান)
প্রকৃতিনিমগ্নতা কবি সুফিয়া কামালের কবিতার একটি বিশেষ দিক। প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন অপার সৌন্দর্যে, যা তার কবিতায় নরম নান্দনিকতায় ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে জীবনের বিশেষ তাৎপর্য খুঁজে পান তিনি।
বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘নির্বাচিত কবিতা : সুফিয়া কামাল’ গ্রন্থের ভূমিকায় প্রাবন্ধিক ফারজানা সিদ্দিকার মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন- ‘বাংলার প্রকৃতি কিংবা বিশ্ব প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ হৃদয়ে উপলব্ধি করেছেন। প্রকৃতিবিষয়ক কবিতায় বর্ষা, হেমন্ত, শীত, বসন্ত যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে ফসলের মাঠ, হাস্নাহেনার সুবাস কিংবা গোধূলির রঙিন সূর্যাস্তের বর্ণময় ছবি। বিশাল-বিপুল পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় রূপ দেখে কেবল তিনি মুগ্ধই হননি, বরং পৃথিবীর প্রাণভাণ্ডার থেকে গ্রহণ করেছেন বিচিত্র রস আর ব্যক্তিগত দুঃখ ভোলার সৌরভ।’
বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বেগম সুফিয়া কামাল কাব্যচর্চা করে গেছেন। তার কবিতায় রবীন্দ্রোত্তর ত্রিশের আধুনিকতা কিংবা ঢাকাকেন্দ্রিক পঞ্চাশের আধুনিক কাব্যভাষা অনুপস্থিত হলেও ভাবের গভীরতা ও প্রকাশের স্বচ্ছতা তার কবিতাকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেছে। তার কবিতায় আধুনিক চিন্তা ও জীবনবোধ ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, নারীর মুক্তি, ব্যক্তিগত স্মৃতিকাতরতা তার কবিতার মূল উপজীব্য। সর্বোপরি দেশপ্রেম ও মানবমুক্তির বার্তা মেলে তার কবিতার পরতে পরতে।
আরও পড়ুন:
জাতীয় কবিতা উৎসব ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি