গণভোট ইস্যুর আড়ালে কি স্বৈরাচারের পুনর্বাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০৬
শেয়ার :
গণভোট ইস্যুর আড়ালে কি স্বৈরাচারের পুনর্বাসন

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরিতে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, গণভোটের আড়ালে পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচারকে পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে কিনা তা এখন খতিয়ে দেখার সময়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানান। দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি না দিয়ে গণতন্ত্রকামী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার তাগিদ দেন তিনি।

চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের সরাসরি ভোটে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র যখন প্রস্তুত হচ্ছে, তখন কয়েকটি রাজনৈতিক দল অধিকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, নিজ নিজ দলীয় সমর্থক নেতাকর্মীদের বাইরেও কিন্তু অরাজনৈতিক কিংবা নির্দলীয় এক বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছেন। তিনি বলেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা শর্ত দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করেই রাষ্ট্রযন্ত্রে খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা, অপরদিকে পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথ সুগম করা। পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগীরা গত কয়েকদিন রাজধানীতে যেভাবে আগুন সন্ত্রাস চালিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে।

বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একটি দল, ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ফ্যাসিবাদীদের ছাতার নিচে আশ্রয় নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পতিত, পরাজিত, পলাতক স্বৈরাচার একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলটির ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে কিনা এ ব্যাপারে ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

তারেক রহমান বলেন, গণভোটের আড়ালে পতিত পরাজিত পলাতক অপশক্তিকে রাষ্ট্র রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা, এ ব্যাপারেও জনগণকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বল্প মেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণ সব ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা আশা করে না। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্বও নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কাছে প্রশ্ন রেখে তারেক রহমান বলেন, দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেছে। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করবে? নাকি গণতন্ত্রকামী জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির জাতীয়ও নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেবে।

রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সংবিধানে লেখা থাকলেই সব কিছু নিশ্চিত হয়ে যায় না। সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র রাজনীতি সম্পর্কে মোনাফেকী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, রাজনৈতিক সমঝোতার ও গণতান্ত্রিক মানসিকতা। সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য রক্ষায় বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে বলেও দাবি করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি অধিকাংশ পয়েন্টেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। জুলাই সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে বিএনপি এইসব অঙ্গীকার রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রাজনৈতিক দলগুলোকে অযথা পরিস্থিতি ঘোলাটে না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছে তাই আদায় করে নিতে চায়, কিংবা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিনা সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।

দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, প্রচলিত রাজনীতির গুণগত সংস্কার চাইলে পুঁথিগত সংস্কারের চেয়ে জননিরাপত্তা ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো রাজনীতিবিদদের কর্ম পরিকল্পনায় আরও গুরুত্ব পাওয়া দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার আরও অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার।

দেশে এবার ১ কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আলু উৎপাদন করে কৃষকরা মনে হয় বিপাকে পড়েছেন। কারণ আলুর উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদিত আলু হিমঘরে রাখতে প্রতি কেজি আলুর পেছনে খরচ পড়ছে প্রায় ২৫ থেকে ২৭ টাকা। অথচ আলুচাষিরা এখন অর্ধেক দামেও উৎপাদিত আলু বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। আলুচাষ করে আলুচাষিরা এবার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অপরদিকে আমরা যদি দেখি দু-একটি রাজনৈতিক দলের আবদার মেটাতে কথিত অকারণ গণভোট করতে হলেও রাষ্ট্রকে প্রায় সমপরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখোমুখি এসব আলুচাষির কাছে এই সময়ে ‘গণভোটে’র চেয়ে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে মনে করি। দেশে চাহিদার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের সক্ষমতা কৃষকদের রয়েছে। তারা যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদনও করছেন। তবে দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমার কাছে মনে হয়, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কথিত ‘গণভোট উৎপাদনের’ চেয়ে সেই টাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপন কৃষকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ভুক্তভোগী কৃষকদের বলার জায়গা কোথায়?

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে দেশে গার্মেন্টস শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। এত সংখ্যক নারী যদি আট ঘণ্টার পরিবর্তে ৫ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হয় তাহলে তাদের বাকি কর্মঘণ্টার টাকা কে দেবে? নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলে চাকরিদাতাদের কৌশলে নারীদের চাকরি না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে কিনা? দেশের নারী সমাজের মধ্যে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ছে আমার মনে হয় এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী নারীদের মনে ছড়িয়ে পড়া চাকরি সংকোচনের আতঙ্ক কাটানো এই মুহূর্তে কথিত ‘গণভোটে’র চেয়ে বেশি দরকার।

নেতাদের বক্তব্য

বিরাজমান সংকটকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি মনে করি, এই সংকট তৈরি করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের যে পথ, সেই পথকে বাধাগ্রস্ত করা; বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে সংস্কারের জন্য যে নির্বাচন হওয়া দরকার, সেই নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা এবং জনগণের ভবিষ্যৎকে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলা।’

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের এই দিনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তাহলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করবে না; কাক্সিক্ষত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংস্কার শুরু করেছিল যেটা তিনি সম্পন্ন করতে পারেননি। তারেক রহমান এখানে আছেন তিনি আমাদের বক্তব্য শুনছেন।

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, নির্বাচন হবে কি হবে নাÑ এই নিয়ে মানুষ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।

জিয়াউর রহমানের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দৃঢ় থাকার আহ্বান জানান বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। তিনি বলেন, রাজাকার, স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিস্টদের চক্রান্তে যদি ড. ইউনূস পরাস্ত হয়, তাহলে সামনে জাতির জন্য ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের বাতিঘর উল্লেখ করে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের সেই টর্চ বেয়ারার বেগম খালেদা জিয়া; বর্তমানে তারেক রহমান। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের বাহকÑ এমন মন্তব্য করে বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, আমরা সেই গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করা, বাংলাদেশের মানুষের মালিকানা বাধাগ্রস্ত করার মতো নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি।

বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম আমানউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ। এ ছাড়া সভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণঅধিকার পরিষদ সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান প্রমুখ।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মনজু, জামায়াতে ইসলামী এহসান মাহবুব জুবায়ের, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।