নিরাপত্তা জোরদার করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৪০
শেয়ার :
নিরাপত্তা জোরদার করুন

তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী বাবলার নিহত হওয়া, চট্টগ্রামে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর ওপর গুলিবর্ষণ, ঢাকার রাস্তায় ফিল্মি স্টাইলে তারিক সাইফ মামুনের খুনÑ গত কয়েক দিনের এই ধারাবাহিক সহিংসতা জনমনে আতঙ্কের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ এবং অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা যেন হঠাৎ করেই বেড়ে উঠেছে। গত সোমবার পর্যন্ত অন্তত সাতটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসব ঘটনার পেছনে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সক্রিয়তা ও অবৈধ অস্ত্রের হুমকি যে আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্যেই স্পষ্ট।

নির্বাচন ঘিরে এমন উত্তেজনা বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন নয়। কিন্তু উদ্বেগজনক হলোÑ ঘটনাগুলোর প্রবাহ, সহিংসতার ধরন এবং অপরাধীদের অপ্রতিরোধ্য চলাচল। আশঙ্কার বিষয় হলো, নির্বাচনের আগেভাগেই ২৮ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্পষ্টতই নির্বাচনী মাঠে দাপট দেখাতে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে অপরাধীচক্রের তৎপরতা মুখ্য শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারÑ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে অস্ত্রের বেপরোয়া ব্যবহার।

কিন্তু সহিংসতার মূল উৎস কোথায়? প্রথমত, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং প্রশাসনিক শিথিলতা একটি বড় কারণ। গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে পুনর্বিন্যাসের চাপে পড়েছে, তা দৃশ্যমান। পুলিশ সদস্যদের প্রতিক্রিয়া ধীর হয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করা এবং অভিযানে দুর্বলতা তৈরি হওয়ার অভিযোগ, পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। একদিকে নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা; অন্যদিকে নিজেদের বিতর্কিত ভূমিকার পুনর্মূল্যায়নÑ এই দ্বৈত চাপ পুলিশের সক্ষমতা দুর্বল করে দিচ্ছে। ফলে সৃষ্ট ফাঁকফোকর অপরাধীচক্র কাজে লাগাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, অবৈধ অস্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত প্রসার। সীমান্ত পথে রাইফেল, মর্টার শেল, পিস্তল, শটগানসহ অস্ত্র দেশে ঢুকছে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া ৫ হাজার ৭০০-এর বেশি অস্ত্রের মধ্যে এখনও এক হাজারের বেশি উদ্ধার হয়নিÑএ সংখ্যাটি দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপুল হুমকি। পুলিশ ও বিজিবির জব্দ তালিকাতেই দেখা যাচ্ছে, অনেক খুন ও সহিংসতায় ব্যবহৃত অস্ত্র পুলিশ থানা বা নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের হারানো তালিকা থেকেই এসেছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে উত্তেজিত পরিবেশে ‘পতিত’ বা নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের ছায়ায় সৃষ্ট নৈরাজ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।

এমন পরিস্থিতির সামাজিক প্রভাবও ভয়াবহ। ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ও খুনের ঘটনায় মানুষের নিরাপত্তাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত জনমনে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছেÑ যা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ নয়। ভোটারদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়লে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাই এখন জরুরি প্রয়োজন সমন্বিত ও জোরালো বিশেষ পদক্ষেপ। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান অতিদ্রুত শুরু করতে হবে। এটি একদিনের বা এক সপ্তাহের অভিযানে সম্ভব নয়; মাসব্যাপী, নিরবচ্ছিন্ন, গোয়েন্দানির্ভর সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি আরও জোরদার করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের উৎস বের করতে হবে।

নির্বাচনী পরিবেশ সুরক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থার পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা শুধু পুলিশের দায়িত্ব নয়Ñ এটি রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের যৌথ দায়িত্ব। রাষ্ট্র যদি এখনই পরিকল্পিত, দৃঢ়, নিরপেক্ষ পদক্ষেপ না নেয়, তবে নির্বাচনী সহিংসতা শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়Ñ জাতীয় নিরাপত্তা সংকটেও পরিণত হতে পারে। অর্থাৎ দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সমন্বিত প্রয়াস।