নতুন ঢঙে মণিপুরী
দেশি পোশাকে দেশি সাজ- এ যেন এক চিরন্তন সৌন্দর্যের নাম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ছোট্ট জনপদ মণিপুরে জন্ম নেওয়া যে অনন্য বয়নশিল্প, আজ তা ছুঁয়ে ফেলেছে পুরো দেশকে। এখন ঐতিহ্যের প্রতীক মণিপুরী পোশাক পেয়েছে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিÑ যা শুধু কাপড় নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতির গর্ব, আমাদের অহংকার। আগে মণিপুরী মানে শুধু শাড়ি বোঝালেও এখন বদলেছে সংজ্ঞা। দেশি-হাউস ঘুরে বিস্তারিত লিখেছেন রিয়ানা ইসলাম রিম্পা
এক সময় মণিপুরী মানেই ছিল উজ্জ্বল রঙে হাতের তাঁতে বোনা ঐতিহ্যবাহী শাড়ি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বয়নশিল্পে এসেছে নান্দনিক পরিবর্তন, আধুনিকতার ছোঁয়া ও ফ্যাশনের নতুন সংজ্ঞা ফিউশন। মণিপুরী কাপড় শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়। তরুণ প্রজন্ম এই ঐতিহ্যকে নিজেদের মতো করে নিচ্ছে নতুন ঢঙে। এখন মণিপুরী কাপড়ে তৈরি হচ্ছে লং কামিজ, স্কার্ট, টপ, কুর্তি, পাঞ্জাবি, ব্লেজার, ব্যাগ, এমনকি জুতো ও স্কার্ফও। ঢাকার বনানী ও সিলেটের কয়েকটি বুটিক ঘুরে দেখা যায়, মণিপুরী কাপড়কে আধুনিক কাটিং, হালকা রঙের মিশ্রণ আর ওয়েস্টার্ন কাটে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় রিংকি’স অ্যাটায়ারের স্বত্বাধিকারী রেহনুমা হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মণিপুরী বুননে আধুনিক ফ্যাশনের ফিউশন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী তাঁতের নকশা ও বুননকে নতুনভাবে তুলে ধরছে রিংকি’স অ্যাটায়ার। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরী ডিজাইন ডেভেলপমেন্টে কাজ করে যাচ্ছেÑ যেখানে ঐতিহ্যের শিকড় ধরে রেখে তৈরি করা হচ্ছে আধুনিক রুচিসম্পন্ন পোশাক। ‘মণিপুরী ফ্যাব্রিকসের টেক্সচার এমন যে, এটিকে ফিউশন ডিজাইনে দারুণ মানিয়ে নেওয়া যায়। এখন অনেকেই ওভারসাইজ শার্ট, কোট বা স্কার্টেও মণিপুরী ব্যবহার করছেন। তরুণ ক্রেতারা এটাকে দেশি স্টাইলের ফ্যাশন হিসেবে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
শীতে গর্ভবতী মায়েদের যত্ন
‘রিংকি’স অ্যাটায়ারের মণিপুরী কাপড়ে ফিউশন কালেকশনে রয়েছে- মণিপুরী শাড়ি, জ্যাকেট, জুতা, ব্যাগ, শ্রাগ, জুয়েলারি, মণিপুরী প্যাঁচ ওয়ার্ক করা আধুনিক পোশাকও। সেই সঙ্গে রিংকি’স অ্যাটায়ারের নিজস্ব ডিজাইনের হ্যান্ডলুম শাড়ি, গামছা, ওড়না, তাঁতের শাল, মাফলারও। রেহনুমা মনে করেন, ফ্যাশনের এই পরিবর্তন প্রমাণ করে- দেশীয় পোশাকও হতে পারে আধুনিক, স্টাইলিশ এবং আন্তর্জাতিক মানের। মণিপুরী বয়নশিল্পের মূল শক্তি এর রঙ ও নকশা। আগে যেসব কাপড়ে কেবল ঐতিহ্যবাহী লাল, কালো, সবুজের ব্যবহার দেখা যেত, এখন সেখানে যোগ হয়েছে প্যাস্টেল শেড, হালকা নীল, গোলাপি ও ক্রিম টোন। সেই সঙ্গে তাঁতের প্যাটার্নেও এসেছে আধুনিক জ্যামিতিক মোটিফ, ফুলের ছায়া ও গুচ্ছ বুনন। এ ছাড়া আগের তুলনায় কাপড় এখন অনেক আরামদায়ক ও হালকা। কটন ও উল মিশিয়ে নতুন ধরনের ফ্যাব্রিকে তৈরি হচ্ছে মণিপুরী, যা গ্রীষ্ম ও শীতÑ দুই মৌসুমেই পরার উপযোগী।
এ বছরের বিশেষ ডিজাইন, ‘মণিপুরী করপোরেট লুক’ যেখানে শাড়ি এবং শর্ট শ্রাগ কম্বো রয়েছে। ‘আগে মানুষ মণিপুরী শাড়ি খুঁজত শুধু পূজার সময়। এখন নিয়মিত অর্ডার করছে কুর্তি, দোপাট্টা আর ব্লেজারের জন্য। বিশেষ করে তরুণীরা অফিস ও ক্যাজুয়াল ফ্যাশনে মণিপুরী যুক্ত করছেন।’ আমি লং জ্যাকেট প্রথম ডিজাইন করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ৫ বছর আগে। তখন এটি ছিল একদম নতুন। তাই চাহিদাও তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে ডিজাইনটার প্রতি একটা শ্রেণির আগ্রহ তৈরি হয় এবং যারা ব্যবহার করেছেন তারা পজিটিভ ফিডব্যাক পেয়েছি নতুন ক্রেতা তৈরি হয়েছে। এ বছর শীত আসার আগেই একশরও বেশি জ্যাকেট বিক্রি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণগুলো জেনে রাখুন
স্থানীয় তাঁতিদের সংগঠন মণিপুরী হ্যান্ডলুম সোসাইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে আমরা শুধু শাড়ি আর চাদর বুনতাম। এখন ডিজাইনাররা এসে আমাদের নতুন ডিজাইন শেখাচ্ছেন। এতে আমাদের কাজের চাহিদা বেড়েছে, রোজগারও আগের চেয়ে অনেক বেশি।’ এই সহযোগিতা গ্রামীণ তাঁতি আর শহুরে ফ্যাশন দুনিয়ার মাঝে তৈরি করছে এক সুন্দর সেতুবন্ধ।
আমাদের পণ্য, আমাদের অহংকার। মণিপুরী এখন শুধুই পোশাক নয়Ñ এটি হয়ে উঠছে বাংলাদেশের একটি পরিচয়ের প্রতীক। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে এই বয়নশিল্পের মর্যাদা যেমন বেড়েছে, তেমনি তাঁতিরাও পাচ্ছেন ন্যায্য দাম ও আত্মসম্মান। দেশি কাপড়ের এই পুনর্জাগরণ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে মনে করিয়ে দিচ্ছেÑ আমাদের ফ্যাশনের শিকড় আমাদেরই সংস্কৃতিতে। একসময় যে মণিপুরী ছিল শুধু গ্রামের তাঁতের গন্ধমাখা এক ঐতিহ্য, আজ তা শহুরে মেয়েদের আলমারিতে জায়গা করে নিয়েছে নতুন রঙে, নতুন ঢঙে। মণিপুরী পোশাকের এই পুনরাবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয়- দেশীয় ঐতিহ্য কখনও পুরনো হয় না, যদি আমরা তাকে ভালোবাসা ও সৃজনশীলতায় নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারি। নিজের সংস্কৃতি, নিজের পোশাকÑ এটাই আমাদের সত্যিকারের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
আরও পড়ুন:
শীতে মুলা কেন খাবেন?