মাঠের কর্মকাণ্ডে নিবিড় নজর বিএনপির
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থীদের কার্যক্রমের ওপর নিবিড় নজর রাখছে বিএনপি। দলটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা কীভাবে এলাকার ত্যাগী ও মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীর সঙ্গে আচরণ করছেন। বিএনপি নেতাদের মতে, প্রার্থীরা ঐক্য গঠনে ব্যর্থ হলে দলের স্বার্থে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও আসতে পারে।
বিএনপি নেতারা বলেন, প্রতিটি আসনে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিরা বঞ্চিত হয়েছেন। এই বঞ্চিতদের তালিকায় অনেক যোগ্যরাও আছেন। যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে অন্যদের মান ভাঙিয়ে ঐক্য গড়া। সেটা করতে ব্যর্থ হলে ধানের শীষের বিজয়ের স্বার্থে প্রার্থী পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত নেবে দল। কিন্তু প্রার্থী যদি ঐক্য তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়ার পরও অন্যরা বিরোধিতা করে, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপি নেতাদের মতে, বিগত ওয়ান-ইলেভেন থেকে আওয়ামী লীগের পুরো শাসন আমল ছিল বিএনপি ও জিয়া পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃসময়। এই সময়ে পর্যায়ক্রমে বিএনপির সহ-সপ্তর সম্পাদক, যুগ্ম মহাসচিব এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে রুহুল কবির রিজভীর সক্রিয় ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়।
রিজভীর মতোই গত ১৭ বছর আন্দোলন করতে গিয়ে কখনও কারাগার, কখনও রাজপথে কাটিয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল, আবদুস সালাম আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইয়েদুল আলম বাবুল, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফত আলী সপু, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনীর হোসেন, ওবায়দুর রহমান চন্দন, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, এসএম জাহাঙ্গীর, মামুন হাসান ও আকরামুল হাসান মিন্টুর মতো নেতারা।
একইভাবে গত ১০ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে নারী নেত্রীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী, আফরোজা আব্বাস, হাসিনা আহমেদ, রুমানা মাহমুদ, সুলতানা আহমেদসহ অনেকে আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। কয়েকজন বেশ কয়েকবার কারাবন্দিও হয়েছেন। এসব নেতা জেল-জুলুমসহ নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলেও গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনের সম্ভাব্য একক প্রার্থী তালিকায় তাঁদের নাম নেই। তালিকায় নাম না থাকায় ত্যাগী নেতারা এবং তাঁদের অনুসারীরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এই নিয়ে গতকাল সোমবার ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে আন্দোলন-সংগ্রামে পাশে পাওয়া কয়েক নেতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেনÑ ‘তাঁদের ভুলি কী করে’। তিনি আরও লিখেনÑ ‘আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দুঃশাসন, চলছে গুম, খুন, হামলা-গায়েবি মামলা, গ্রেপ্তারÑ চারদিকে আতঙ্ক। বিএনপির নেতাকর্মী ও তাঁদের পরিবার-পরিজন ঘরছাড়া। বিএনপি বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে একটা শব্দ উচ্চারণ করা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। এমন পরিস্থিতিতে দলের কর্মসূচি পালন করা ছিল মৃত্যুসম। সেই সময় রাজপথে অথবা কারাগারে অথবা রিমান্ডে ডিবি অফিসে অথবা আদালত পাড়ায় যাঁরা ছিলেন আমাদের সাথী, যাঁরা আন্দোলন সফল করতে আমাদের মতো মাঠের কর্মীদের দিকনির্দেশনাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বিলকিস ইসলাম, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য নিলোফার চৌধুরী মনিসহ ঢাকা জেলার প্রতিটি নেতাকর্মী বিশেষ করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপি। এই মানুষগুলোর অবদান ভুলে যাওয়া আমাদের মতো মাঠের কর্মীর জন্য খুব কঠিন।’
নিপুণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘গ্রেপ্তার এড়িয়ে কীভাবে কর্মসূচি করা যায়, তাঁদের কাছ থেকে নানা পরামর্শের পাশাপাশি রাজপথেও পেয়েছি। জুলাই আন্দোলনে হাসিনা সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করলেও নরমাল ফোনে কথা বলে দলের দিকনির্দেশনা আদান-প্রদান করা হতো। আজ ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অবদান রাখা প্রতিটি নেতাকর্মীর মঙ্গল কামনা করি।’
গত ৩ নভেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে ২৩৭ আসনে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলাম। এরপর আমাদের সঙ্গে যাঁরা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, সেই সব দলের সঙ্গে কথা বলে যেসব আসন আমরা ঘোষণা করিনি, তাঁরা আসতে পারেন। অথবা আমাদের আসনও আমরা পরিবর্তন করতে পারি, এটা আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা বলতে চাইÑ এটা আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা।’
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, তালিকা ঘোষণা করার সময় সম্ভাব্য প্রার্থী উল্লেখ করায় বঞ্চিতরা অনেকেই পরিবর্তনের আশায় মাঠে নেমেছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় জমায়েত করছেন। কোনো কোনো আসনে দলীয় প্রার্থীর চেয়ে বঞ্চিত প্রার্থীর সভা-সমাবেশ বড় হচ্ছে।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে অথবা ঘোষণার অপেক্ষায় আছেÑ প্রতিটি আসনে নজর রাখা হচ্ছে। ঘোষিত ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের প্রকৃত অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য বলেন, প্রার্থীর নড়বড়ে ভাব, ইমেজ সংকট এবং মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কোনো বিষয় থাকলে ঘোষিত তালিকায়ও পরিবর্তন আনা হবে। তবে এ তালিকা খুব বেশি বড় হবে না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নাটোর-১ (লালপুর-বাঘাতিপাড়া) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে প্রয়াত বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলকে। এই আসনে আরও দুজন মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেনÑ বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও পুতুলের ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ভিপি ইয়াছির আরশাদ রাজন। পুতুলের প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকে টিপু ও রাজনের সমর্থকরা পৃথকভাবে বিক্ষোভ করছেন। পুতুলের প্রার্থিতা বাতিল না করলে টিপু স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে বিএনপির প্রার্থী আমজাদ হোসেন। তাঁর পরিবর্তে জেলা বিএনপির সভাপতি জাভেদ মাসুদকে প্রার্থী করার দাবিতে আন্দোলন করছেন তাঁর অনুসারীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমানকে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই নেতার পরিবর্তন দাবি জানিয়ে নানা কর্মসূচি করছেন মনোনয়নবঞ্চিত কবীর আহমেদ ভূঁইয়ার অনুসারীরা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে প্রার্থী না করায় চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন সেখানকার নেতাকর্মীরা। এই আসনে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারকে মনোনয়ন না দেওয়ায় সড়কে বিক্ষোভ করেছেন তাঁর সমর্থকরা।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরীকে কুমিল্লা-৬ আসনে দলের মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশ। তারা আসনটিতে দলের প্রার্থী হিসেবে চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা আমিন-উর-রশিদকে (ইয়াছিন) চান।
আরও পড়ুন:
সাকিবকে নিয়ে যা বললেন ওবায়দুল কাদের
কুমিল্লা-১০ (নাঙ্গলকোট ও লালমাই উপজেলা) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার সমর্থকরা বিক্ষোভ করছেন। এই আসনে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়াকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য ইলেন ভুুট্ট ঝালকাঠি-২, সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুল নরসিংদী-৪, সরওয়ার জামাল নিজাম চট্টগ্রাম-১৩, আলী আজগর লবি খুলনা-৫ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। নিষ্ক্রিয় নেতারা মনোনয়ন পাওয়ায় এসব আসনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গাইবান্ধা-৫, কুমিল্লা-৯, সাতক্ষীরা-২, হবিগঞ্জ-৪, কক্সবাজার-৪ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সেখানকার নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করছেন। বিএনপি নেতা বলেন, যে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, এটা পরিবর্তনযোগ্য। অতএব, ক্ষোভ যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বিবেচনায় নেওয়া হবে।