ডাকসু কী চাইলেই বলপ্রয়োগ করতে পারে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচিত কার্যকরী সদস্য সর্বমিত্র চাকমার ক্যাম্পাসে ভবঘুরে উচ্ছেদ অভিযানের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তা নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হাতে লাঠি নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে ভবঘুরে উচ্ছেদ করছেন সর্বমিত্র।
ডাকসুর এমন উচ্ছেদ অভিযান চালানোর এখতিয়ার না থাকার পরেও কিভাবে তারা হাতে লাঠি নিয়ে এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে—বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে যথেষ্ট। উত্তর খুঁজতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভিডিওটি দেখেছি, তাতে যে মারমুখী আচরণ দেখা গেছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। যদিও ভিডিওটিতে সরাসরি আঘাত করার দৃশ্য নেই। আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের একজন ব্যাগের ওপর তিনটা আঘাত করেছে, ভয় দেখানোর জন্য। আমার দায়িত্ব শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কিন্তু আমি যদি কাউকে থাপ্পড় দিই বা চড় মারি—এটা একদমই কাম্য নয়। এই বিষয়ে আমি একদম পরিষ্কার, শারীরিক আঘাত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
ডাকসু কী চাইলেই বলপ্রয়োগ করতে পারে?—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, ডাকসু বলপ্রয়োগ করতে পারে না। বলপ্রয়োগের জন্য আমাদের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে- ডিএমপি, সিটি কর্পোরেশন, মেট্রো, সমাজসেবা অধিদপ্তর, নারকোটিক্স বিভাগ রয়েছে। প্রত্যেক সংস্থার নিজস্ব দায়িত্ব আছে। তাই বলপ্রয়োগের দায়িত্বও নির্দিষ্ট বাহিনীর।’
ডাকসুর জন্য এভাবে বলপ্রয়োগ করা কাঙ্ক্ষিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ওদের বলেছি—তোমরা বলপ্রয়োগের জন্য এনটাইটেল না।’
ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহল বিশেষ করে ছাত্রদল ও বামপন্থী সংগঠনগুলো এর সমালোচনা করে। তাদের দাবি ভবঘুরে বা মাদকসেবী যেই হোক, কাউকে লাঠি দেখিয়ে তাড়ানো ডাকসুর কাজ নয়। কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় দিতে হবে; শাস্তি দেওয়ার অধিকার ডাকসুর নেই।
এবিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমার মনে হয়, ডাকসু নেতাদের ডাকসুর গঠনতন্ত্রটা ঠিকঠাক পড়া এবং বোঝা উচিত। কেননা তারা এমন কিছু কার্যক্রম করার চেষ্টা করছে যেটা কোনোভাবেই তাদের দায়িত্বের আওতায় আসে না। লাঠি হাতে ডাকসুর এক সদস্যের যে ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে তা কোনোভাবেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা দীর্ঘদিনের চর্চিত পুরোনো ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই ভবঘুরে, পাগল, মাদকাসক্তদের ক্যাম্পাস থেকে উচ্ছেদ করতে হবে, তবে সেটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে প্রশ্ন করা এবং চাপ প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের মাধ্যমে যে কাজটি করার কথা সেটি আমরা করতে গেলে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে এবং সেটাই হচ্ছে। কোনোভাবেই দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে কোনো ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার অধিকার কারো নেই এবং এভাবে আইন ভঙ্গ করলে সেটি অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে।’
বামপন্থি সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, ‘ডাকসুর কোনো সদস্যের দ্বারা ক্যাম্পাসে থাকা হকার, ভবঘুরে ব্যক্তিদের লাঠিপেটা কিংবা শারীরিক আক্রমণের মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্পূর্ণ বেআইনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আইনি প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা না করে গুণ্ডামির মাধ্যমে মূলত একটা স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করছে। ডাকসুর ব্যক্তিদের এই ধরনের শারীরিক আক্রমণ এবং মারধরের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছে—তাদেরকে মাদকব্যবসায়ীসহ নানাবিধ ট্যাগিং করার মাধ্যমে নিজেদের ফ্যাসিস্ট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতিপূর্বে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তার স্বার্থে একইভাবে ভিন্নমতের শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের আক্রমণ করতো, প্রতিবাদকারীদের বিভিন্ন ট্যাগে অভিহিত করতো। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক কিন্তু তা কোনোপ্রকার বেআইনি মারধর বা শারীরিক আক্রমণের মাধ্যমে নয় বরং যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই।’
আলোচনা-সমালোচনার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচিত কার্যকরী সদস্য সর্বমিত্র চাকমা মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) গভীর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে জানান, তিনি তার ক্যাম্পাসকে ভবঘুরে, পাগল ও গাঁজাখোরমুক্ত দেখতে চান।
সর্বমিত্র লিখেছেন, ‘যে বৃদ্ধ লোকটিকে দেখছেন, আমি শুরুর দিন থেকে এই লোকটাকে সেই মেট্রো স্টেশন থেকে তুলছি প্রতিরাতে। লোকটা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়-ই না, উনার সঙ্গে আরেকজন আরো এক বৃদ্ধ, তিনিও মাদকাসক্ত। এই লোকের কাছে এর আগেও একবার গাঁজা পাওয়া গেছিল।’
আরও পড়ুন:
ইবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে তালা!
সর্বমিত্র লিখেছেন, ‘কিছুদিন আগে তিনজন মাদকাসেবীকে তুলতে গিয়েছিলাম। একইভাবে পোস্ট করে আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছে। এদের তাড়ানোর জন্য লাঠি হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যারা মাঠে কাজ করে তারাই জানে—এটা কতটুকু কঠিন।’
ডাকসুর এমন কর্মকাণ্ড অন্যান্য সদস্যরা কিভাবে দেখছেন—এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ডাকসুর আরেক নির্বাচিত সদস্য হেমা চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে জানান, সর্বমিত্রের এমনভাবে উচ্ছেদ অভিযানকে তিনি ‘ক্রিটিক্যালি’ দেখছেন। হেমা চাকমা বলেন, “আমাদের চিন্তা করতে হবে ডাকসু সদস্যদের এই কার্যক্রমগুলো ‘লং টার্মে’ কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।”
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা সকলেই উল্লেখ করেছি—নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার। তবে নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার ক্ষেত্রে ডাকসুর সদস্যরা প্রতিদিন এমন উচ্ছেদ অভিযানে অংশগ্রহণ করতে পারবে না কারণ তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী। আমরা প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি, যেন উচ্ছেদের কাজগুলো প্রশাসনিকভাবে নিয়মের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।’
শিক্ষার্থীদের ভাবনা কি এই বিষয়ে তা জানতে একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা হয় আমাদের সময়ের এই প্রতিবেদকের। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেলেও তারা ডাকসু সদস্যদের এমন ‘ডমিনেন্ট ও মারমুখী আচরণ’ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ ওসমানী বলেন, ‘ডাকসু প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি। তাদের কাজ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, অধিকার ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেখা। কিন্তু তারা যেভাবে মারমুখী আচরণ করছে এবং যেভাবে তারা একটা অটোক্রেটিক (স্বৈরাচারী) সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা মোটেও ঠিক না।’
প্রশাসনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা উচিত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা চাইলে পুলিশ বা সিটি করপোরেশনের লোকজনকে সম্পৃক্ত করতে পারতো। কিন্তু তারা প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে গিয়ে যেভাবে মবের মতো আচরণ করেছে তা শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি তৈরি করছে।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সামিহা হায়দার আমাদের সময়কে বলেন, ‘সর্ব মিত্রর উচ্ছেদ অভিযান এ আইনি প্রক্রিয়া বা নৈতিক জায়গা থেকে কোনোভাবেই সমর্থন করার সুযোগ নাই। ডাকসু সদস্য বলে যা নয় তাই করার অধিকার তিনি রাখেন না। এইটা কোনো অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করার মত সমস্যা না। ইস্যু মাদক না, ইস্যু ক্ষমতা দেখানো। কোন সাহসে সর্বমিত্র লাঠি নিয়ে যায় একটা বয়স্ক লোকের সামনে? আমার কাছে এটা বর্বরতার পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও হাজারটা সমস্যা আছে। সবকিছু একটা সুষ্ঠু কাঠামোর মধ্যে সমাধান করতে হবে।’