জামায়াত-এনসিপির চাওয়া বাস্তবায়ন করছে সরকার ও কমিশন

নজরুল ইসলাম
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০১
শেয়ার :
জামায়াত-এনসিপির চাওয়া বাস্তবায়ন করছে সরকার ও কমিশন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশমালা জমা দিয়েছে, তার অনেকগুলোতে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির অভিমত, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চাওয়া বাস্তবায়ন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এখানে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ লিপিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও দেওয়া হবে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সুপারিশমালা জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পর রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ভার্চুয়ালি এই বৈঠক রাত ১০টা থেকে শুরু হয়ে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলার পর মুলতবি ঘোষণা করা হয়। গতকাল বুধবার রাতে ফের মুলতবি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উভয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

গতকাল দুপুরে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তা হলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল? তিনি বললেন, জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা প্রতারণা।

দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা বলেন, এটা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এটা করে ঐকমত্য কমিশন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে কার্যত অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বিএনপি এখন মনে করছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-একটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। এগুলোকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময়ে না করার অপচেষ্টা হিসেবে দেখছে দলটি।

দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে। তবে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থেকে যায়। এমন অবস্থাতেই গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা তুলে দেন। সরকারকে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, গত ১৭ অক্টোবর দেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল যে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং কমিশন যে সুপারিশমালা জমা দিয়েছে তার সঙ্গে মিল নেই। আমরা মনে করি, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। নেতারা গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারিকৃত লিগাল ফেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) এবং আইয়ুব খান প্রবর্তিত বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাদের অভিমত, কমিশনের সুপারিশে ঠিক একইভাবে দুটি দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো এগুলো বাংলাদেশে আনার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।

লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও), ১৯৭০ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জারিকৃত একটি ফরমান। এতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের নীতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এই এলএফও ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয় যে, আইনসভায় ৩০০টি আসন থাকবে। ফ্রেমওয়ার্কে রাষ্ট্রের দুই অংশের জন্য সংখ্যানুপাতের কথা বলা হয়। আরও উল্লেখ করা হয় যে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের ১২০ দিনের মধ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তবে এ সময়ের মধ্যে নতুন আইনসভা সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হলে নতুন নির্বাচন দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ হচ্ছে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রবর্তিত একটি পরোক্ষ নির্বাচনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা, যা মূলত তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার একটি উপায় ছিল। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচন করত না; বরং ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নামে পরিচিত প্রায় ৮০ হাজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হতো, যাদের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। এ ব্যবস্থার অবসান ঘটে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতনের সঙ্গে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদের পূর্ণ প্রতিফলন নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, রেফারিকে তারা কখনও গোল দিতে দেখেননি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি একটি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। অথচ বিএনপির যা প্রস্তাবনা, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সেগুলোর কিছুই রাখা হয়নি। বরং বিএনপি যেগুলো চায়নি, সেগুলোই তারা করছে। ঐকমত্য কমিশন এখন কার্যত ‘অনৈক্য কমিশন’ হয়ে গেছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঐকমত্য কমিশন যদি সবকিছু তাদের ইচ্ছেমতো করে, তা হলে বিএনপিকে তো কমিশন বৈঠকে না ডাকলেই পারত। বিএনপিকে বাদ দিয়ে সুপারিশ জমা দেওয়া, এটা কি ঐকমত্যের কোনো চিহ্ন?