রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি

মো. আদনান আরিফ সালিম
২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৯
শেয়ার :
রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূত্র ধরে যে নয়া বিশ্বব্যবস্থার মেরুকরণ সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে অর্থনীতি। ডলারের বিপরীতে অন্য নানা দেশের কারেন্সির হ্রাস-বৃদ্ধি আর বাণিজ্য বিস্তারের সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে মুখ্য। তবে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের সম্পর্ক কোনো ক্ষেত্রেই অস্বীকার করা যায় না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজের বিভাজন এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের চরমপন্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক কাঠামোও শক্তিশালী হচ্ছে। অর্থনীতির প্রতি এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু রাজনৈতিক পটভূমিতে নয়, বরং বৈশ্বিক মানবিকতার জন্যও গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বের নানা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দগুলো ছেঁটে ফেলছে। তারা মানবতার থেকে বাণিজ্যকে কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইছে। তারা সব সম্পর্ক ও আধিপত্যকে বিচার করতে চাচ্ছে অর্থনীতি নিয়েই।

এমনি পরিস্থিতিতে আমলে নেওয়া যেতে পারে কেনেথ রগোফের বক্তব্য। তিনি তার ‘The Perils of Economic Centrism in a Polarized World’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি রাখঢাক না করে সরাসরি লিখেছেন, ‘Few ideas in economics have been as misrepresented as the link between debt and growth. More than a decade ago, a prominent analysis was falsely cast as a call for austerity when, in fact, it showed something far more mundane: countries burdened by heavy debt often have limited room to invest or respond when crises strike.’

রগোফের ধারণার সরল বাংলা আমরা এভাবে করতে পারি, ‘অর্থনীতিতে ঋণ ও প্রবৃদ্ধির সম্পর্কের মতো ভুলভাবে ব্যাখ্যার ধারণা খুব কমই আছে। এক দশকেরও বেশি আগে এক প্রভাবশালী বিশ্লেষণকে ভ্রান্তভাবে কৃচ্ছ্রসাধনের আহ্বান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যদিও বাস্তবে সেটি অনেক বেশি সাধারণ সত্য প্রকাশ করেছিল। সেখানে যে দেশগুলো ভারী ঋণের বোঝা বহন করে, তাদের পক্ষে সংকটের মুহূর্তে বিনিয়োগ করা বা কার্যকর প্রতিক্রিয়া জানানো প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে।’ বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।

আমাদের অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, রাজনৈতিক শক্তির সমষ্টি যখন এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, তখন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণও তার সঙ্গী হয়। আমরা একদিকে রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের প্রভাব যেমন বিশ্লেষণ করতে পারি, তেমনি অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কে একটি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করব।

তবে অর্থনীতি নিয়ে যে কিছু ধারণা সবচেয়ে বেশি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ঋণ এবং প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক। এক দশক আগে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণকে কট্টর দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল, যা আসলে ছিল একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ। ওদিকে ঋণের ভারে জর্জরিত দেশগুলো সংকটের সময়ে খুবই সীমিত হয়ে পড়ে, তাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায় এবং এই পরিস্থিতি তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।

বর্তমান পৃথিবীতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন তীব্রতর। তাই মধ্যপন্থি অর্থনীতিবিদ হওয়া যেন এক অদৃষ্টপূর্ব চ্যালেঞ্জ। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ইন্টেলেকচুয়াল শিবিরে যে কোনো ধারণাকে মুহূর্তেই একপক্ষীয় দৃষ্টিতে ঠেলে দেওয়া হয়। লিওন ট্রটস্কির একটি প্রবাদে যেমন বলা হয়েছে, ‘সেন্ট্রিস্ট অর্থনীতিবিদরা যুদ্ধ চায় না, কিন্তু যুদ্ধ তাদের প্রতি আগ্রহী হয়’, (Centrist economists may not be interested in war, but war is interested in them.) তারই প্রতিফলন ঘটছে বর্তমান যুগে।

রগোফের ২০১৬ সালে লেখা বই The Curse of Cash--এর কথাই ধরা যাক, যেখানে নগদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের আলোচনা ছিল। বইটি প্রকাশের পর, তিনি একাধিক মৃত্যুর হুমকি পান। তার মৃত্যুর হুমকিদাতাদের মধ্যে কিছু ছিল মাদক ব্যবসায়ী এবং অস্ত্রধারীদের পক্ষ থেকে, যারা তার ১০০ ডলারের নোট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। আবার অন্যদিকে কিছু ছিল ক্রিপ্টোকারেন্সির সমর্থকদের পক্ষ থেকে। তারা মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মন্তব্য করায় রগোফকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

রগোফ একজন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তাদের হুমকিগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। যদিও এসব ব্যক্তি কিছুটা অস্বাভাবিক ছিলেন। তবে তারা বইটির মূল তত্ত্বগুলো বুঝে ফেলেছিলেন। ফলে তাদের কেবল বিরোধিতা ছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে অভিন্ন লেখক এবং করমেন রেইনহার্ট Growth in a Time of Debt নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তখন বিপরীত পরিস্থিতি দেখা দেয়। এই গবেষণায়, ইউএমএম আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অর্থনীতিবিদ তাদের কাজের বিরুদ্ধে একাধিক ‘ভুল’ তথ্য তুলে ধরেন। তাদের মতে, এই বিশ্লেষণ ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর আঁটসাঁট নীতি গ্রহণে সহায়ক হয়েছে। এরপর থেকেই একটি ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নেয়, যা আজও বহুজনের কাছে বিদ্যমান।

সত্যিকার অর্থে, রগোফদের গবেষণায় শুধু একটি ছোটখাটো ভুল ছিল। তবে সেটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণায়, যা পরবর্তী সম্পাদিত সংস্করণে শুধরে ফেলা হয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তাদের মূল তত্ত্বটি ছিল ‘বেশি ঋণ থাকা দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে ধীর হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, সরকারি ঘাটতি বা ঋণ সঞ্চয় করার জন্য কোনো ধরনের ক্ষতি করে। বরং দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা ভবিষ্যতের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।’

গবেষণায় দেশগুলোকে দুটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। একটি যেখানে ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৯০% বা তার বেশি এবং অন্যটি যেখানে ঋণের পরিমাণ কম। তবে এই ৯০% কোনো একেবারে নির্দিষ্ট সীমা নয়, বরং একটি সংজ্ঞারূপক যা শুধু বোঝাতে চেয়েছিল যে উচ্চ ঋণের দেশগুলো গড়ে তুলনামূলকভাবে কম উন্নতি সাধন করে। আমরা বারবার স্পষ্ট করেছি যে, ৯০% ঋণ সংকট কোনো বিপর্যয় ডেকে আনবে না, যেমনটি বলা হয়, ‘যতটুকু ঋণ, ততটুকু বিপদ’, এমন এক ধারণা।

ঋণ ও প্রবৃদ্ধির মধ্যে যে তাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু শক্তিশালী ব্যাখ্যা রয়েছে। যখন সরকারি ঋণ বাড়ে, তখন বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য স্থান কমে যায়, আর ঋণ পরিশোধের জন্য যে করগুলো ধার্য করা হয়, তা সাধারণত অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমনকি যখন ঋণ অনেক বাড়ে, তখন সরকারি খাতে সংকটের সময়ে জরুরি বিনিয়োগ বা সেবা প্রদান করার সুযোগ কমে যায়।

যখন বিতর্কটি শেষ হয়ে যায় এবং গবেষকরা তথ্যের পুনরালোচনা শুরু করেন, তখন তারা দেখতে পান যে মূল তত্ত্বগুলো যথাযথ ছিল। তবে রগোফরা কখনই ঋণ এবং প্রবৃদ্ধির মধ্যে কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করার দাবি করেননি, বরং শুধু একটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সময়ের সঙ্গে, সম্ভবত এর সঠিক ব্যাখ্যা আরও পরিষ্কার হবে।

সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং ভুলভাবে উপস্থাপিত ধারণা ছিল যে রগোফরা আঁটসাঁট নীতির পক্ষে কথা বলেছেন। আসলে তারা যে ভুলটি করেছিলেন, তা ছিল ঋণ এবং প্রবৃদ্ধির মধ্যে একটি আপসের ধারণা উপস্থাপন করা। অর্থাৎ তাদের মূল বক্তব্য ছিল যে একদিকে ঋণ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তবে তার আকার এবং তার ফলে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বিচার করতে হবে, বিশেষত যদি তা দীর্ঘমেয়াদি ঋণগ্রস্ততা সৃষ্টি করে।

সেন্ট্রিস্ট অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিবিদদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো যে, তারা যেন কোনো পক্ষের সম্পূর্ণ সমর্থক না হয়ে শুধু বাস্তবতার কথা বলেন, কিন্তু তাতে অনেক সময় তাদের অবস্থানকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এর পরও কিছু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কারণ সাম্প্রতিক বিশ্বব্যবস্থার বদলের সূত্র ধরে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ধারণাগুলোর প্রতি কিছুটা প্রশমিত মনোভাব তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে যদি সঠিক এবং উদারপন্থি আলোচনা সামনে আসে, তবে আগামীদিনে আরও যুক্তিপূর্ণ বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তবে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো পরিবেশ এখন নেই। তারা যে প্রচেষ্টাই গ্রহণ করুক বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির ফাঁস তাদের অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলছে।

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব