বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী থেকে জেলার নিয়ন্ত্রক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেহরক্ষী থাকার সুবাধে ধীরে ধীরে মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি জেলা কমিটির সভাপতি পদে আসীন। নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন পুরো জেলা। দলের নেতাকর্মীরা তাঁর কাছে ছিলেন কোণঠাসা।
ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে তাঁর পরিবারের অন্তত ছয়জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের শীর্ষ পদ দখলে রেখেছেন। জেলা পরিষদ, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা, সদর উপজেলা, জেলা আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জেলা যুবলীগÑ সর্বশেষ জাতীয় সংসদের আসন মুন্সীগঞ্জে সবই ছিল এক পরিবারের দখলে। নিজে ছাড়াও স্ত্রী, ছেলে, ভাই, ভাতিজা, ভাইয়ের বউ ও পুত্রবধূ দলের বিভিন্ন কমিটির শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির একাধিক চেয়ারেও বসেছেন তাঁরাই। এক কথায়, বিগত ১৬ বছরে মহিউদ্দিন পরিবারের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ে মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ।
এদিকে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে আসে মহিউদ্দিন ও তাঁর পরিবারের হাতে। পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হয় ক্ষমতাসীন এই দলটিতে। দলের যত কমিটির শীর্ষ পদ আর জনপ্রতিনিধিদের চেয়ার দখলে নেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
ক্ষমতার তিন মেয়াদে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদ পান আনিছুজ্জামান আনিস। একই সঙ্গে চার মেয়াদে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মহিউদ্দিনের এই ভাই।
২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র হন মহিউদ্দিনপুত্র হাজী মো. ফয়সাল বিপ্লব। পরবর্তী সময়ে পৌর মেয়র থেকে পদত্যাগ করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হন ফয়সাল বিপ্লব। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কাঁচি প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাসকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিপ্লব। আবার মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার পুনর্নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মহিউদ্দিনের পুত্রবধূ তথা ফয়সাল বিপ্লবপত্নী চৌধুরী ফাহরিয়া আফরিন।
এভাবেই একে একে সংসদ সদস্যের চেয়ার, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রের চেয়ারে বসেছেন মহিউদ্দিন পরিবারের সদস্যরা। গড়ে তোলেন পরিবারতন্ত্র। জেলা আওয়ামী লীগ পুরোই গিলে নিয়েছিল মহিউদ্দিন পরিবার।
এদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মহিউদ্দিন গা ঢাকা দেন। কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পলাতক অবস্থা থেকে ফিরতে শুরু করলে তিনিও প্রকাশ্যে আসেন। এসেই মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন।
১৯৮৬ সালের তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন। ১৯৯১ সালে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এরপর থেকে তিনি দলের এ শীর্ষ পদ আঁকড়ে ধরে আছেন।
২০০৭ সালে আলোচিত এক-এগারোর সময় শীর্ষ ৫০ দুর্নীতিবাজের একজন চিহ্নিত হন মহিউদ্দিন। ওই সময়ও দীর্ঘদিন পলাতক থাকেন তিনি।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন দলটিকে নিজেদের পরিবারের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য যা কিছু দরকার ছিল, সবই করা হয়েছে এই পরিবারটির পক্ষ থেকে। এর বাইরে কেউ সুবিধা করে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি মুন্সীগঞ্জে। এমনকি স্বাধীন সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপের ঘটনাও ছিল নিয়মিত।
অভিযোগ আছে, জেলা আওয়ামী লীগের ‘আজীবন সভাপতি’ খ্যাত মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগের টানা শাসনামালে পদ ও নৌকা মার্কা নিয়ে বাণিজ্য করে কামিয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকা। এ ছাড়া বালুমহাল থেকে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। কথিত আছে, শুধু রাজনীতি করে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে মহিউদ্দিন পরিবার।
শহরের কাচারী চত্বরে দুই ভাইয়ের আলিশান মার্কেট, কোর্টগাঁও এলাকায় কয়েক একর জমি ও বিশাল দুটি অট্টালিকা, ঢাকায় মোহাম্মদপুরে বিলাসবহুল বাড়ি, কক্সবাজারে জমিÑ সব মিলিয়ে বিশাল সম্পদের মালিক এই পরিবার।
অন্যদিকে ভাই আনিছুজ্জামান আনিসের কত একর জমি আছে শহর ও শহরের বাইরে, তা হিসাব করা যায়নি। মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার দুইবারের মেয়র ছিলেন ফয়সাল বিপ্লব। মেয়াদকালে টেন্ডারবিহীন লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত করেন পৌরসভা কার্যালয়কে। নিজের পছন্দমতো ছাত্রলীগ নেতাদের বাইরে কেউ কাজ পাননি। এ থেকেও বিপ্লবকে দিতে হয়েছে কমিশন।
অন্যদিকে বিপ্লবের চাচাতো ভাই আক্তারউজ্জামান রাজিব ও জালালউদ্দিন রুমি রাজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুটপাট, জমি দখল, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজির অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। রাজিব টানা ১৯ বছর ছিলেন যুবলীগের দায়িত্বে। কোনো কোনো কমিটির বিনিময়ে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষও নিয়েছেন তিনি। এছাড়া সদর উপজেলা পরিষদের সব টেন্ডারের একচ্ছত্র আধিপত্যও ছিল এই দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে মহিউদ্দিন পরিবারে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ওই দিনই শহরের কোর্টগাঁও এলাকার বাসভবন থেকে পালিয়ে যান মহিউদ্দিন পরিবারের সদস্যরা।
এর মধ্যে বড় ছেলে মুন্সীগঞ্জ-৩ সাবেক এমপি ফয়সাল বিপ্লবকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে ঢাকায় ও মুন্সীগঞ্জে কয়েকটি হত্যা মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সর্বশেষ সোমবার ফয়সাল বিপ্লবকে ফের রিমান্ডে এনেছে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশ। এ ছাড়া মহিউদ্দিনসহ পরিবারের সবাই আত্মগোপনে আছেন।
জানা গেছে, ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন তিনজন। শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার নিহতের ঘটনায় দায়ের করা পৃথক মামলায় মহিউদ্দিন পরিবারের প্রায় সবাই আসামি।
এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সজল মোল্লা (৩০) নিহতের ঘটনায় ২০ সেপ্টেম্বর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তাঁর ছেলে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লবসহ ৪৫১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহতের ছোট ভাই সাইফুল মোল্লা।
এর আগে ২০ আগস্ট রিয়াজুল ফরাজীর স্ত্রী রুমা আক্তার বাদী হয়ে ও ৩০ আগস্ট নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজলের নানি শেফালি বেগম বাদী হয়ে একই থানায় হত্যা মামলা করেন।
আরও পড়ুন:
সাকিবকে নিয়ে যা বললেন ওবায়দুল কাদের
তৃণমূল নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, মহিউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাঁর অনুজ আনিস সহ-সভাপতি ছিলেন না শুধু, তাঁদের পরিবারের হাতেই ছিল যুবলীগ, মহিলা লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের শীর্ষ পদ।
আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতার আমলে দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর জেলা যুবলীগের সভাপতি পদে ছিলেন মহিউদ্দিনের ভাতিজা আক্তারউজ্জামান রাজিব। মহিউদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যাডভোকেট সোহানা তাহমিনা হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
এ ছাড়া তাঁর অনুজ তথা ছোট ভাই আনিছুজ্জামান আনিসের স্ত্রী তহুরা জামান হয়েছেন জেলা মহিলা লীগের সভাপতি এবং ভাতিজা জালালউদ্দিন রুমি রাজন হয়েছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি।