পিআর নিয়ে রাজনৈতিক দলে মতবিরোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পিআর নিয়ে রাজনৈতিক দলে মতবিরোধ

প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করা উচিত কিনা- এ নিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কেউ মনে করেন, পিআর ব্যবস্থা চালু হলে প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন নিশ্চিত হবে এবং নির্বাচনে অনিয়ম কমবে। আবার কেউ সতর্ক করে বলেছেন, জনগণ এখনও এই পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত নয়, তাড়াহুড়া করে গণভোট আয়োজন করলে রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। গতকাল কসমস ফাউন্ডেশন ও ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) আয়োজিত ‘ইলেকশন ২০২৬ : এ ক্রিটিক্যাল লুক অ্যাট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এ মত প্রকাশ করেন। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মামুন আল মোস্তফা।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে গণভোট করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে কে দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, পিআরের জন্য আমাকে গণভোটে যেতে হবে কেন? আমাদের তো প্রত্যেকটি দলের অনেকগুলো ইস্যু আছে, যেগুলো ঐকমত্য হয়নি। তা হলে যদি গণভোটের প্রক্রিয়ায় আপনি যেতে চান, আগামী দুই বছর যাবৎ আপনাকে গণভোটই করতে হবে। এই দায়িত্ব আমাদের কে দিয়েছে? জনগণ গণভোট করার এই দায়িত্ব আমাদের দেয়নি।

আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে কীসের ভিত্তিতে? সংবিধানের ভিত্তিতে। সংবিধানের ভিত্তিতেই সরকার চলছে। সুতরাং বর্তমান সংবিধানের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার চলে গেলে, আমাদের গণতান্ত্রিক অর্ডারকে যদি ফিরিয়ে আনতে হয় এবং পরবর্তীতে পরিবর্তন

করতে হয়, প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানের আওতায় নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক অর্ডারে আসতে হবে আগে।

পিআর পদ্ধতিতে দলীয় কিছু আসন বৃদ্ধি ছাড়া জনগণের জন্য কোনো সুবিধা নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান। তিনি বলেন, আমি কেন পিআর চাচ্ছি? একটু যদি আমরা খোলাখুলি বলি, পিআরটা চাচ্ছি এই কারণে যে পার্লামেন্টে কিছু বেশি সিট পাব, এর বাইরে কিছু নেই। এখন আমি পার্লামেন্টে অধিকতর ক্ষমতাবান হব, অধিক সিট পাব- সেই কারণে মানুষের মৌলিক যে দাবি সেটাকে আমি অগ্রাহ্য করব, এটা তো গণতন্ত্রের ভাষা নয়। কাজেই সেদিক থেকে এটা সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি।

কসমস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতউল্লাহ খানের সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা বক্তব্য দেন। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী মহাসচিব এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম রোধ এবং প্রতিটি ভোটের যথাযথ মূল্যায়নের জন্য সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।

পিআর ব্যবস্থার সুবিধা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে জনগণ প্রার্থীর নয়, দলের প্রতীক দেখে ভোট দেয়। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থায় ভোটার দলীয় প্রার্থীকে বেছে নেয়। ফলে একজন প্রার্থী ব্যক্তিগত প্রভাব তৈরি করে, পেশিশক্তি ব্যবহার করে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে, সহিংসতার আশ্রয় নেয়, কেন্দ্র দখল করে। ফলে নির্বাচন হয়ে ওঠে অন্যায্য এবং ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

তিনি বলেন, এই অনিয়ম ও অস্বচ্ছ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পিআর একটি কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে। এ ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা দলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ মনোনয়ন ও অর্থায়ন দল নিয়ন্ত্রণ করে। দল প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে প্রার্থীদের চূড়ান্ত করে।

আযাদ আরও বলেন, এর ফলে বহু অনিয়ম এড়ানো সম্ভব হয়। নির্বাচন হয় সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ। ভোটের মূল্যায়নই মূল বিষয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পিআর ব্যবস্থার প্রয়োজন।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাংলাদেশের ভোটাররা এখনও পিআর পদ্ধতি বোঝে না। তাই নিম্নকক্ষে (জাতীয় সংসদে) পিআর নিয়ে এখনই আলোচনা জরুরি নয়। আমরা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চাই, যাতে সরকারের ওপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ ও ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নিশ্চিত হয় এবং স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দমন করা যায়।

মান্না আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে, তা হলে সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা মসৃণ হবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ৭৮ শতাংশ মানুষ পিআর চায়- এই প্রচারণা উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশের জনগণ এখনও মানসিকভাবে এই পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত নয়। যখন কমিশনে এ বিষয়ে আলোচনা চলছিল, তখন কিছু রাজনৈতিক দল রাজপথে পিআর নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে- তারা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে, নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?

তিনি বলেন, আমরা উচ্চকক্ষে পিআর সমর্থন করি, কিন্তু নিম্নকক্ষে পিআরের কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট নির্বাচনের দিনই হওয়া উচিত, এতে সম্পদ সাশ্রয় হবে। নির্বাচনের আগে গণভোট হলে তা বিপজ্জনক হতে পারে- যদি ভোটার উপস্থিতি কম হয়, তবে উল্টো ফল আসতে পারে। নিয়মিত পাঁচ বছর পরপর সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেই অনেক সমস্যা দূর হবে। এক সঙ্গে সব অর্জন করতে গেলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যদি ভোট রাতেই হয়, তবে পিআর হোক বা প্রচলিত পদ্ধতিতে হোক, তাতে কোনো পার্থক্য হবে না। সবচেয়ে জরুরি হলো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। অনেক দেশে পিআর ভালোভাবে কাজ করছে, আবার অনেক দেশে প্রচলিত ব্যবস্থাই কার্যকর। উচ্চকক্ষে পিআর এবং নিম্নকক্ষে প্রচলিত পদ্ধতি বজায় রাখাই উত্তম সমাধান হতে পারে।

তিনি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানান।

গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান মো. শহিদুল ইসলাম রুবেল বলেন, পিআর ব্যবস্থার কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। এর কার্যকারিতা নির্ভর করে কোন ধরনের পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে তার ওপর।