সাক্ষাৎকারে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক /

‘বাম দলগুলোকে এক মঞ্চে আনাই আমাদের অঙ্গীকার’

মুহম্মদ আকবর
০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
‘বাম দলগুলোকে এক মঞ্চে আনাই আমাদের অঙ্গীকার’

আবদুল্লাহ ক্বাফি রতন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক। সম্প্রতি দলের জাতীয় কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। দলের ভেতর-বাইরের অবস্থা, দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থা এবং সিপিবির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মুহম্মদ আকবর

আমাদের সময় : আপনি নতুন দায়িত্ব পেলেন। কেমন বোধ করছেন?

আবদুল্লাহ ক্বাফি রতন : এটা আমার দায়িত্ব, প্রমোশন না। আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে আছি ১৯৮৪ সাল থেকে। অনেকে ছাত্র ইউনিয়ন করতে করতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা। কমিউনিস্ট পার্টিতে এসে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। আমাকে বলা হয়েছিল যে, কমিউনিস্ট পার্টি সরাসরি করা যায় না, তোমাকে কোনো না কোনো একটা গণসংগঠন করতে হবে। তুমি ছাত্র ইউনিয়ন করো। সেইভাবে আমি ১৯৮৪ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়েছিলাম। ঢাকার থানা, মহানগর কমিটিতে কাজ করে ১৯৯৯ সালে সপ্তম কংগ্রেসে আমি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসি এবং টানা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছি। ১৯৯৭ সালের পরে ২০২৫ সালে এসে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। এর আগে প্রেসিডেন্ট মেম্বার ছিলাম। মাঝখানে গণসংগঠন যুব ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলাম সাড়ে ৭ বছর।

আমাদের সময় : জাতীয় কাউন্সিল কেন্দ্র করে নানা ধরনের কথাবার্তা চলছিল। অনেকেই বলছিলেন- খেলাঘর, উদীচী ভাগ হয়েছে, এবার কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়নি। কিন্তু এক ধরনের অদৃশ্য বিভেদ রয়ে গেছে। এখানে অমুক ঘরানা তমুক ঘরানা আছে। আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : দেখুন, আমাদের মধ্যে এমন স্পেকুলেশন সবসময় আমি দেখি। কমিউনিস্ট পার্টিতে এই বছর কম হয়েছে। গত বছর বা এর আগের বছর পত্রিকায় প্রচুর নিউজ হয়েছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাচ্ছে। এইবার আপনাদের গণমাধ্যমেও প্রি-কংগ্রেসে আমি এমন কোনো নিউজও দেখিনি। হয়তো আমি ব্যস্ত ছিলাম বলে দেখিনি। বরং আমাদের এবার ঐক্যটা আরও মজবুত হয়েছে। আমি এটুকু বলতে চাই, আমাদের পার্টি আরও দৃঢ় হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। মতামতের পার্থক্য থাকতে পারে। গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও আমাদের মতামতের পার্থক্য ছিল। আমরা যাঁরা একেবারে সক্রিয়ভাবে রাজপথে ছিলাম, ওই ৩৬ দিন রাজপথে ছিলাম, তাঁদের এক ধরনের চিন্তা। আর শেখ হাসিনা সরকার চলে গেলে কে আসবে এই আশঙ্কাও ছিল অনেকের মধ্যে। এটাই হলো পার্থক্য।

আমাদের সময় : আপনারা নতুন দায়িত্ব নিয়ে বাম নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। কী বিষয়ে আলোচনা হলো?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : বৈঠকটা ছিল মূলত ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা কী হবে, সেটা নিয়ে। ওখানে অনেকগুলো অপশন আছে। বিএনপির অপশন আছে। জামায়াতের অপশন আছে। এনসিপির অপশন আছে। আমরা সবগুলো অপশনকে একটা জায়গায় নিয়ে এসে কমন অপশনে দাঁড় করাতে চাচ্ছি। অন্তত আমরা যারা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, তাঁরা যাতে ঐকমত্য তৈরি করতে পারি, সেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

আমাদের সময় : নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : মিটিংয়ের শেষে আমরা একটু আলোচনা করেছিলাম। দেশের যে বর্তমান পরিস্থিতি এবং যে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যেভাবে একটা ফলস ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করছে- আমরা সেই ফলস ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে আছি। একসঙ্গে কাজ করতে পারি কি না, আলোচনা করেছি। আমাদের কংগ্রেসও কিন্তু এই দায়িত্ব দিয়েছে- বামপন্থি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা। সে অনুযায়ী ভোটে বাম দলগুলোর একটা বাক্স রাখার চেষ্টা করব। এটা আদর্শগত কোনো জোট হবে না। কংগ্রেসে আমরা বলেছি, বিএনপির একটা বাক্স আছে, জামায়াত এবং ইসলামী দলগুলোর একটা বাক্স আছে। আমরা একটা বাক্স রাখতে চাই- তৃতীয় বাক্স। বাংলাদেশের সাত-আট কোটি গরিব-মেহনতি মানুষ যাতে এই বাক্সে ভোট দিতে পারেন।

আমাদের সময় : আপনারা ১৪ নভেম্বর একটা সমাবেশের ডাক দিয়েছেন। সেখানে কী বাম দলগুলোকে একমঞ্চে আনবেন? কী বার্তা দেবেন সমাবেশ থেকে?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : তার আগে ৩১ অক্টোবর একটা কনভেনশন করব। সেই কনভেনশনে সামাজিকভাবে যারা অনগ্রসর, যারা পিছিয়ে আছে, তাদের নিয়ে একটা কনভেনশন করব। আমাদের ওই কনভেনশন থেকে চার্টার অব ডিমান্ড আসবে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেত মজুরের যে লড়াই, সেই লড়াইয়ের পাশাপাশি এবার দলিত আদিবাসী যারা শোষণের শিকার, তাদেরকে আমরা যুক্ত করব। তারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করবে। আমরা গরিব মানুষের সরকার চাই। আমাদের দলীয় পরিকল্পনা হচ্ছে- ২০২৬ সালে আমরা ইলেকশন করব, ২০৩১ সালে ধাক্কা দেব, ২০৩৬ সালে আমরা বিজয় অর্জন করব। এই চিন্তার অংশ হিসেবেই বাম দলগুলোকে এক মঞ্চে আনা, ভোটে এক বাক্স সৃষ্টি করা আমাদের কংগ্রেসের অঙ্গীকার।

আমাদের সময় : আপনারা যারা বাম রাজনীতি করেন, তাঁদের সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে দেওয়া হয় যে, যাঁরা বাম রাজনীতি করেন, তাঁরা ধর্ম থেকে অনেকটা দূরে। সেক্ষেত্রে যাঁরা ধর্মাশ্রয়ী ভোটার, তারা হতাশ হন কি না?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : প্রথম কথা হচ্ছে, আমার কাজ কিন্তু ধর্ম প্রচার করা না বা ধর্মের বিরুদ্ধে বলা না। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমি সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করি বলেই একদল লোক বলে যে, আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। যেমন- একসময় কোনো একজন ইসলামী ওয়াজকারী বলতেন যে, হাতের পাঁচ আঙুল সমান না। সুতরাং, ধনী-গরিব থাকবে। আমরা এটার পাল্টা কী বলতাম জানেন? হাতের পাঁচ আঙুল সমান না। কিন্তু আপনি যখন ভাত খেতে বসেন, আপনি যখন নলা তৈরি করেন, তখন এই পাঁচটা আঙুল কিন্তু এক জায়গায় আসতে হবে। না হয় ভাত খেতে পারবেন না। আমাদের কাজ হচ্ছে বৈষম্য নিরসন। ধর্মকে উচ্ছেদ করা আমাদের কাজ না। আমরা প্রতিটি লোকের ধর্ম পালন করার অধিকার নিশ্চিত চাই। আবার কেউ যদি ধর্ম পালন করতে না চান, তাঁরও অধিকার নিশ্চিত চাই। আমাদের পার্টিতে যাঁরা ধর্ম পালন করেন, যারা মানে, নামাজ-রোজা করেন, বা যাঁরা মন্দিরে যান, পূজা করেন, উৎসব করেন, আমরা তো কাউকে বাধা দিই না। বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই। প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে।

আমাদের সময় : সংবিধান নিয়ে আপনার অবস্থান কী?

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণার আলোকে গৃহীত। আমরা সেই মূল চেতনার ধারায় সমতার সমাজ চাই। সংবিধান বাতিল নয়, বরং প্রগতিশীল ধারাগুলো শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য।

আমাদের সময় : আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : ধন্যবাদ আপনাকেও।