যোগ্য হলেও নারীরা দলের প্রার্থী তালিকায় উপেক্ষিত

শাহজাহান মোল্লা
০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
যোগ্য হলেও নারীরা দলের প্রার্থী তালিকায় উপেক্ষিত

স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ‘৯০ গণ-অভ্যুত্থান, ‘২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানসহ সব অধিকার আদায়ে নারীরা ছিলেন সামনের সারিতে। কিন্তু ভোটের রাজনীতি এলেই প্রার্থী বাছাইয়ে দলের কাছে তাঁরা সবসময় থাকেন উপেক্ষিত। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নারী। এ ছাড়া স্পিকার, মন্ত্রী পদেও নারীরা ছিলেন। তারপরও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা অন্য নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করতে গেলেই দলগুলোর কাছে উপেক্ষিত থেকে যান নারী প্রার্থীরা। নির্বাচনের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, বিগত কয়েক দশকে নারী প্রার্থীর হার কখনই ৫ শতাংশের বেশি হয়নি।

দলগুলো মুখে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও দলের নেতৃত্ব ও ক্ষমতাসীন পদে নারীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ বাড়েনি। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরই মধ্যে অনেক দল যোগ্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে। কিছু কিছু দল প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করলেও এখনও প্রকাশ করেনি। ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির প্রার্থী তালিকায়ও নারীমুখ হাতেগোনা। তাও আবার ঘুরেফিরে রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যই বেশি। দলের মনোনয়নের দৌড়ে টিকে যান বাবা বা স্বামীর উত্তরসূরিরাই। পরিবারের কেউ রাজনীতিতে না থাকলে হঠাৎ করে দলের বড় পদ বা মনোয়ন পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে নারীদের ক্ষেত্রে।

দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুইজন নারী। স্পিকার থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি পদেও ছিলেন একাধিক নারী। তারপরও দলের নেতৃত্বে ও ক্ষমতার রাজনীতিতে নারীরা উপেক্ষিত। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, নেতৃত্বের কাক্সিক্ষত পর্যায়ে এখনও নারী পিছিয়ে থাকার পেছনে তাঁদের অনাগ্রহ, পরিবারিক বাধা, ধর্মীয় বাধা, নিরাপত্তাহীনতা এবং আর্থিক স্বাবলম্বিতার অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যেতে পারছে না। তবে ধীরে ধীরে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সভাপতি ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী থাকলেও দলীয় পদে বা এমপি মনোনয়নে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। কারণ, তাঁরা নারী হলেও নারীর প্রতিনিধিত্ব করেননি। তাঁরা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একজন স্বামীর উত্তরসূরি আরেকজন বাবার উত্তরসূরি। নারীর প্রতিনিধিত্ব না থাকাতেই নারীরা উপেক্ষিত।

সংসদ সদস্য হওয়ার মতো সব গুণ থাকলেও নানা কারণে দলগুলোর কাছে নারীরা উপেক্ষিত। আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের সাধারণ আসনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম নামে একটি সংগঠন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনে একটি লিখিত আবেদনের মাধ্যমে সংগঠনটি এ দাবি জানায়।

নারী সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য মাহীন সুলতান বলেন, ‘আমরা চাই নারীর সমান প্রতিনিধিত্ব স্থাপন হোক, নারী রাজনীতিবিদ এবং ভোটারের জন্য সমান সুযোগ তৈরি হোক।’ তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে দলগুলোকে সংরক্ষিত আসনের বাইরে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারীপ্রার্থী দিতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বেশি। তাই নেতৃত্বে নারীদের সংখ্যা বাড়েনি। নেতৃত্বে যেই থাকুক নারীবাদী চিন্তা না থাকলে ক্ষমতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক সমাজকর্মী খুশি কবীর আমাদের সময়কে বলেন, যেখানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫১ ভাগ নারী। সেখানে নেতৃত্বে নারীদের সংখ্যা খুবই কম। রাজনৈতিক দলগুলোয় নারী নেতৃত্বে মেনে নেওয়ার প্রবণতা কম। নারী নেতৃত্ব তাঁকেই মানে, যারা বাব বা স্বামীর উত্তরাধিকারী।

তাই নারী নেতৃত্বে বাড়াতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব পরিবর্তন দরকার। এ ছাড়া নির্বাচনে যে হারে কালো টাকা ও পেশিশক্তির মহড়া চলে সেখানে নারীরা টিকে থাকতে পারেন না, তাই নারীরা নেতৃত্বে এগিয়ে আসছেন না। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে দলগুলোর ভেতরের নারীবাদী চিন্তা বাড়াতে হবে।

আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং ২০১৮ সালে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন রিটা রহমান। তিনি রংপুর-৩ থেকে মনোনয়ন পান। তবে সেই নির্বাচনের মাঝপথে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় তিনি পরাজিত হন। রিটা রহমান এরপর আর মাঠের রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না। এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে নাটোর-২ আসন থেকে নির্বাচন করেন সাবিনা ইয়াসমিন, সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে রুমানা মাহমুদ, পটুয়াখালী-২ আসন থেকে সালমা আলম, ঝালকাঠি-১ থেকে জীবা আমিনা খান, শেরপুর-১ আসন থেকে ডা. সানসিলা জেবরিন, নেত্রকোনা-৪ থেকে তাহমিনা জামান, মানিকগঞ্জ-৩ থেকে আফরোজা খান রিতা, ঢাকা-৯ থেকে আফরোজা আব্বাস, ঢাকা-১১ থেকে শামীম আরা বেগম, ফরিদপুর-২ থেকে শামা ওবায়েদ ইসলাম, সিলেট-২ থেকে তাহসিনা রুশদীর, কক্সবাজার-১ থেকে হাসিনা আহমেদ। ২০১৮ সালে যাঁরা বিএনপির মনোয়ন পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই বিগত সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি সব সময় নারীর ক্ষমতায়নে বিশ^াস করে, সেদিক দিয়ে যাঁদের যোগ্যতা আছে এবং বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন, এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে- সেই সব নারী নেত্রীকে প্রার্থী হিসেবে দল বিবেচনা করবে।

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের কাজ শুরু হয়েছে। বিএনপিতে এবার সরাসরি ভোটে প্রার্থিতার দিক থেকে আলোচনায় রয়েছে বেগম সেলিমা রহমান, অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী, নার্গিস ইসলাম, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, হেলেন জেরীন খান, শাম্মী আখতার, নিলোফার চৌধুরী মনি, রেহেনা আক্তার রানু, বিলকিস জাহান শিরীন, ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, ফারজানা শারমিন পুতুল, মাহমুদা হাবিবা, নায়াবা ইউসুফ, সাবিরা নামমুল মুন্নি। বিগত বছরগুলোয় এই নারী নেত্রীরা আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্বে দিয়েছেন। অনেকে জেল, জুলুম অত্যাচার সহ্য করে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনও চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়ন না দিলেও কোনো কোনো প্রার্থীকে সবুজ সংকেত দিয়ে আসনভিত্তিক কাজ করার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে দলটি। নতুন এই দলের প্রার্থীর দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিবের পদে এসেছেন নাহিদা সারওয়ার নিভা, যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, মনিরা শারমিন, তাজনুভা জাবীন। গেল বছর ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সেøাগান ও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে এসব তরুণীকে। এনসিপি গঠনের পর জুলাই পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচিতে অনেক সময় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন নারীরা। তাঁরা রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য না হয়েও নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার আদায়ে মাঠে রয়েছেন। এবারের নির্বাচনে তাঁদের অনেকেই দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।

বিএনপির পরই সাংগঠনিক ও জনসমর্থনের দিক দিয়ে এই মুহূর্তে বড় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও কোনো আসনেই নেই নারীপ্রার্থী। দলটির নেতৃত্বেও নারীদের অংশগ্রহণ নগণ্য। অন্য একটি ইসলামী দল খেলাফত মজলিস ২৯৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তাদের প্রার্থী তালিকায়ও নেই নারীপ্রার্থী। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এই দলটির প্রার্থী তালিকায়ও নেই নারী প্রার্থী।

জামায়াতের ৩০০ আসনের প্রাথমিক তালিকায় নেই কোনো নারী প্রার্থী- এ বিষয়ে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে ৩০০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই তালিকায় কোনো নারীপ্রার্থী নেই। যখন সুযোগ আসবে তখন দেখব। আমরা বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি।’

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত মোতাবেক ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারীপদ পূরণের বিধান রয়েছে। তবে গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। অন্য দল আরও পিছিয়ে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নারী নেতৃত্ব নেই বললেই চলে।

বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত অধিকাংশ দল যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, সেই নির্বাচনেও নারী প্রার্থীর হার ছিল খুব সামান্য। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৪৮ প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ৬৮ জন। শতাংশের হিসাবে সেই নির্বাচনে নারী প্রার্থী ছিল ৩.৬৭ শতাংশ।

এক-এগারোর সরকারের সময় ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ৩৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেবার বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই জেলে ছিলেন। যে কারণে অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি। তাঁদের অনুপস্থিতিতে কারও মেয়ে কারও স্ত্রী নির্বাচন করেন। তাই সেবার নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। নবম সংসদ নির্বাচনে ৬৪টি আসনে ৫৯ নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেবার মোট প্রার্থী ছিল ১ হাজার ৫৬৭ জন। নারী প্রার্থীর হার ছিল ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশনের তৈরি প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩০০ আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বৈধ মোট ১ হাজার ৮৯১ প্রার্থীর মধ্যে নারীপ্রার্থী ৯২ জন। শতাংশের হিসাবে যা ৪.৮৬ শতাংশ।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের সাধারণ আসনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া এবং দলীয় ও স্বতন্ত্র নারী প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরাম।

নির্বাচনবিষয়ক গবেষক নেসার আমিনের লেখা ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ফলাফল’ বইয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের হিসাব অনুযায়ী ৩৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন, ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ৩৬ নারী প্রার্থীর মধ্যে আট, ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩৮ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ছয়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য হিসেবে। আর সর্বশেষ ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৬৯ জন নারী প্রার্থীর মধ্যে ২২ জন সারাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য জলি তালুকদার আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী।