পূজাবাড়ির গল্প একাল-সেকাল

লাবণ্য লিপি
০১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পূজাবাড়ির গল্প একাল-সেকাল

আগামীকাল বিজয়া দশমী। বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় উৎসব। দুর্গাপূজা মানেই যেন মহাধুমধাম, ঢাকের বাদ্য, নতুন পোশাক পরে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, অঞ্জলি দেওয়া, খাওয়া-দাওয়া, অতিথি আপ্যায়ন। বহু বছর ধরে চলে আসছে এ উৎসব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্পগুলো বদলে যায় উৎসব উদযাপনের সংস্কৃতি। কেমন ছিল ছোটবেলার পূজা? আর এখন কতটা বদলে গেছে? সেই গল্পই শোনালেন বিশিষ্টজনরা। লিখেছেন লাবণ্য লিপি

ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ছোটবেলায় পূজার আমেজ শুরু হতো মাসখানেক আগে থেকেই। শরতের নীল আকাশ, পেজা তুলার মতো উড়তে থাকা কাশফুল এসবই মনে করিয়ে দিত পূজা আসছে। কোনো কাজে আর মন বসত না। আমি বড় হয়েছি নারায়ণগঞ্জে। স্কুল ছুটি হলেই আমি দৌড়ে যেতাম মন্দিরে। সেখানে প্রতিমা গড়ার কাজ চলত। আমি অবাক হয়ে দেখতাম খড়ের কাঠামোতে শিল্পী কেমন একটু একটু করে হাত-পা, শরীর, মুখ গড়ছেন! কী নিখুঁত সে কাজ! অপেক্ষা করতাম দেবীর চোখ কবে আঁকা হবে। তারপর মহালয়া আসত। দেবীর চোখ এঁকে দৃষ্টি দান করা হতো। কী যে সুন্দর সেই চোখ! আমি সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকতাম। ষষ্ঠী থেকে শুরু হতো মন্দিরে মন্দিরে ঘোরাঘুরি। অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ নেওয়া, পালা দেখা, যেন ফুরসতই পেতাম না। পূজার সময় মাকে দেখতাম সাদা শাড়ির লাল পেড়ে গরদ পরতে। আমরাও অনেক জামা-কাপড় উপহার পেতাম। প্রতিদিন নতুন জামা-কাপড় পরে ম-পে যাওয়া খুব আনন্দের ছিল। আমরা মাঝে মাঝে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেও যেতাম পূজার সময়। গ্রামেও খুব আনন্দ হতো। পূজার কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে নিরামিষ রান্না হতো। কী স্বাদ ছিল সেই লুচি, ছোলার ডাল, সবজি। মাছ খেতাম আমরা দশমীর দিনে। এটা অবশ্য আমার বাসায় এখনও মানা হয়। তবে এখন সবকিছুই বদলে গেছে। এখন প্রতিমার চেহারাও যেন বদলে গেছে। প্রতিমাকে চোখ ধাঁধানো শাড়ি, লেহেঙ্গায় একেবারে মাধুরী-ঐশ^রিয়া বানিয়ে দেয়। ম-পে ম-পে সব প্রতিমাই যেন একইরকম দেখতে। কোনো বৈচিত্র্য নেই। পরিবর্তন এসেছে মানুষের সাজ- পোশাকে। আমরা যারা ’৯০-এর দশকে ফ্যাশন নিয়ে কাজ শুরু করি, আমরাই কিন্তু শারদীয় উৎসবের পাঁচ দিনের সাজ-পোশাকে উৎসবের আমেজ ফুটিয়ে তুলি। উৎসবের থিম, ঋতু বৈচিত্র্য, পূজার মোটিফ ব্যবহার করে পোশাক ডিজাইন শুরু করি। বর্তমানে ফ্যাশন খাতে দুর্গাপূজার থিমে পোশাক তৈরি করছে সবাই। আমার কথা হলো, কাজ সবাই করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা যেন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করেই করি। ঐতিহ্যকে বিকৃত করে নয়, তবে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল তো হতেই পারে।

কবি ও প্রাবন্ধিক শেলী সেনগুপ্ত বলেন, আমাদের ছেলেবেলায় পূজার আয়োজন ছিল সীমিত, কিন্তু আনন্দ ছিল অবারিত। তখন এখনকার মতো এত বেশি ম-প হতো না। গ্রামে হয়তো একটা ম-প হতো। সেখানেই হতো সব আয়োজন। পুরো গ্রামের মানুষ ওই ম-পকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠত। পূজা আসার অনেকদিন আগে থেকেই আমরা অপেক্ষা করতে থাকতাম। তখন অত মার্কেট বা শপিংমল ছিল না। আমরা গজ কাপড় কিনে জামা বানাতে দিতাম পাড়ার দর্জির কাছে। তারপর দিন গুনতে থাকতাম কবে হবে নতুন জামা, কবে পাব। সেই জামা লুকিয়ে রাখতাম যেন কেউ পূজার আগে দেখতে না পায়। আর ষষ্ঠীর দিন থেকেই সকালবেলায় ¯œান করে নতুন জামা পরে ম-পে গিয়ে বসে থাকতাম, হয়তো পুরোহিত মশাই তখনও আসেননি। আমাদের ছেলেবেলায় পূজার সময় যে গানবাজনা হতো তা পাড়ার ছেলেমেয়েরাই করত। বাইরে থেকে শিল্পী আনতে হতো না। দাদা-কাকারাই নাটক লিখে দিতেন। সবাই মিলে সেই নাটকে অভিনয় করত। এতে প্রতিভার বিকাশ ঘটত। এখন তো টাকা দিয়ে বড় বড় শিল্পী আনা হয়। ঘরে তো প্রস্তুতি শুরু হতো অনেক আগে থেকেই। বাড়িতে অতিথি আসবে, তার প্রস্তুতিও শুরু হতো অনেক আগে থেকেই। নারু, মোয়া, সন্দেশ তৈরি হতো। মা-ঠাকুরমা নানারকম পিঠা বানাত। পূজার সময় বাড়িতে মেয়েরা জামাই, সন্তানদের নিয়ে চলে আসত, যেভাবে দুর্গা আসে বাপের বাড়ি। তারপর পূজা শেষ হলে সবাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে যে যার জায়গায় ফিরে যেত। ঠিক যেমন দুর্গা মাকে আমরা চোখের জলে বিদায় দিই। এসবই এখন বদলে গেছে। এখন মেয়েদের বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকার অবসর নেই। ছেলেমেয়েদের পড়া থাকে, বাবা-মায়ের কাজ থাকে। পূজার সময় এখন বাসায় রান্নাই হয় না। ম-পে ম-পে ঘুরে সবাই বাইরে খেয়ে বাসায় ফেরে। ছোটরা এখন নারু- সন্দেশ না, পিৎজ্জা, বার্গার খায়। অনেক শিশু চেনেও না এই খাবারগুলো। কারণ আমাদের মা-চাচিরা এগুলো তৈরি করতেন। এখনকার মায়েদের সেই সময় নেই। এটা হতেই পারে। কারণ আজকের নারীরা শুধু ঘরেই নয়, বাইরেও তারা সমানভাবে কাজ করেন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, নতুন প্রজন্ম যেন আমাদের নিজস¦ সংস্কৃতি ভুলে না যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবে নতুন মাত্র যোগ হতেই পারে, তবে মাহাত্ম্য যেন ভুলে না যাই!