কনটেন্টের যুগে শিল্প-সাহিত্য

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কনটেন্টের যুগে শিল্প-সাহিত্য

বর্তমান যুগকে মোটাদাগে অনেকেই কনটেন্টের যুগ বলে চিহ্নিত করে থাকেন। কেন করেন, তার কারণ কমবেশি সবাই জানি। যখনই সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করি, তখনই অজস্র তথ্য, ছবি, ভিডিও এবং কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ ও আবৃত্তির ভিড়ে ডুবে যাই। এই বিপুল পরিমাণ কনটেন্ট উৎপাদন এবং ভোগের সংস্কৃতি শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া একদিকে যেমন লাখ লাখ মানুষের কাছে সৃজনশীল কাজ পৌঁছে দেওয়ার এক অভাবনীয় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সৃজনশীলতার মূল ভিত্তি সাহিত্যকেই তীব্র চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে যতই ইতিবাচক ও নেতিবাচক কথা হোক না কেন, এর সুযোগ ও সম্ভাবনা একেবারে কম নয়। শিল্পী, লেখক, কবি এবং অন্যান্য সৃজনশীল মানুষের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলো (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এক্স, টিকটক) নিজেদের কাজ তুলে ধরার একটি বিশাল মঞ্চ এনে দিয়েছে। একজন অনামী শিল্পীও রাতারাতি বিখ্যাত হতে পারেন, যদি তার তৈরি কনটেন্ট ভাইরাল হয়। এখন বই প্রকাশের প্রথাগত জটিলতা এড়িয়ে একজন লেখক সরাসরি পাঠকের কাছেও পৌঁছাতে পারেন। ইনস্টাগ্রামে একজন চিত্রশিল্পী তার চিত্রকর্মের ছবি পোস্ট করে সারাবিশ্বের মানুষের প্রতিক্রিয়া পেতে পারেন। ইউটিউবে একজন কবি তার কবিতা নিজে কিংবা পেশাদার আবৃত্তিকার দিয়ে আবৃত্তি করিয়ে হাজার হাজার শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে পারেন। এখানেই শেষ নয়, সোশ্যাল মিডিয়া শিল্পী ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। মন্তব্য, শেয়ার ও লাইকের মাধ্যমে সৃজনশীল কাজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এই মিথস্ক্রিয়া শিল্পীকে তার কাজের মানোন্নয়নে সাহায্য করে এবং নতুন সৃষ্টির জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। পাঠকের সঙ্গে লাইভ চ্যাট করে একজন লেখক তার বইয়ের চরিত্র বা প্লট নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, যা প্রথাগত মাধ্যমে সম্ভব নয়।

তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এ সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে সৃজনশীলতার জন্য বেশকিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এখানে কনটেন্ট তৈরি হয় মূলত ‘ভাইরাল’ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। ফলে অনেক সময় মানের চেয়ে সহজবোধ্যতা, চটকদারিত্ব এবং ক্ষণস্থায়ী জনপ্রিয়তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। গভীর চিন্তা-ভাবনা, নিরীক্ষামূলক শিল্পকর্ম বা জটিল সাহিত্যকর্মের চেয়ে হালকা, দ্রুত পাঠযোগ্য বা দর্শনযোগ্য কনটেন্ট বেশি প্রাধান্য পায়। এটি শিল্প ও সাহিত্যের গভীরতা ও মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ পরিসরের কাজেরও অবমূল্যায়ন হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম এবং ব্যবহারকারীদের মনোযোগের স্বল্পতা দীর্ঘ পরিসরের বা গভীর শিল্পকর্মের জন্য অনুকূল নয়। একটি দীর্ঘ উপন্যাস, একটি বিস্তারিত চিত্রকর্ম সিরিজ বা একটি ধীরগতির পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র সহজে ভাইরাল হয় না। এখানে ছোট, তাৎক্ষণিক ও সহজে হজমযোগ্য কনটেন্টের জয়জয়কার। হতাশার বিষয় হলো, অনুকরণ এবং মৌলিকতার অভাবও স্পষ্ট। সৃজনশীলতা আসলে নতুন কিছু সৃষ্টি করা, কিন্তু যখন সবাই একই ধরনের ট্রেন্ড অনুসরণ করে, তখন নতুনত্বের অভাব দেখা দেয়।

এসব প্ল্যাটফর্ম বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখাই তাদের মূল লক্ষ্য। ফলে এমন কনটেন্টকে উৎসাহিত করা হয়, যা বেশি ‘এনগেজমেন্ট’ তৈরি করে; শৈল্পিক মূল্যের সঙ্গে যা সব সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে। তা ছাড়া মানসিক চাপ ও আত্মতুষ্টির অভাবও এখানে প্রকট। লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের ওপর ভিত্তি করে শিল্পীর আত্মমূল্যায়ন তৈরি হয়। কম প্রতিক্রিয়া পেলে অনেক শিল্পী হতাশ হয়ে পড়েন। বেশি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। এই প্রবণতা শিল্পীর স্বাধীন চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তাকে জনরুচির দাস করে তুলতে পারে। কবি-সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ শিল্পীর সবচেয়ে বড় সম্পদ তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর ও মৌলিকতা। শিল্পীর দায়িত্ব, প্রচলিত ধারণা চ্যালেঞ্জ করা এবং নতুন পথের সন্ধান দেওয়া; জনরুচির অনুকরণ করা নয়। তবে কনটেন্টের যুগ শিল্প ও সাহিত্যের জন্য একটি মিশ্র আশীর্বাদ। সোশ্যাল মিডিয়া নিঃসন্দেহে কোটি কোটি মানুষের কাছে শিল্পের দ্বার উন্মোচন করেছে এবং নতুন প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়েছে। একইসঙ্গে এটি শিল্পীর সৃজনশীলতা, মৌলিকতা ও গভীরতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এ দুইয়ের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা অত্যন্ত জরুরি। কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের নিজেদের কাজ, দর্শন ও মূল্যবোধে অটল থাকতে হবে, একই সঙ্গে নিজেদের কাজকে আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। দিনশেষে, শিল্প ও সাহিত্য তখনই সার্থক, যখন তা মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করে, চিন্তার উদ্রেক করে এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে; শুধু লাইক আর শেয়ারের সংখ্যা দিয়ে বিচারযোগ্য নয়। আমাদের মনে রাখা উচিত হবে যে, শিল্প-সাহিত্যে টিকে থাকতে হলে সাধনার কোনো বিকল্প নেই। া