দলগুলোর ঐকমত্য হয়নি বুধবার ফের সংলাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দলগুলোর ঐকমত্য হয়নি বুধবার ফের সংলাপ

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গতকালের আলোচনায়ও ঐকমত্য হয়নি। বিএনপি বলছে, সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের মতামত নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান আদেশ বা গণপরিষদ কিংবা গণভোটের দাবি জানিয়েছে। কমিশন আগামী বুধবার ফের সংলাপে বসবে। পাশাপাশি কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এদিনের সংলাপের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে একটি ‘মহোৎসবের নির্বাচন’। এর মধ্য দিয়েই জাতির সত্যিকারের নবজন্ম হবে। এত ত্যাগ সার্থক হবে যদি আমরা সেই নবজন্ম অর্জন করতে পারি। এ জন্য জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমঝোতায় আসতেই হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। এটিই একমাত্র সুযোগ এবং আমাদের এটা গ্রহণ করতেই হবে। সমঝোতা বলেন, ঐক্য বলেন, আর যাই বলেন, যখন নির্বাচনে যাব তখন একমত হয়ে সবাই যাব। এর মধ্যে কোনো দ্বিমত আমরা রাখব না।

সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, স্বৈরাচার যাতে না আসতে পারে, সেজন্যই সংস্কার প্রয়োজন। ঐকমত্য কমিশনের কাজ বিশ্বব্যাপী নজির হয়ে থাকবে। এটি যেন খুতোয়ালা নজির না হয়, এটা আমার আবেদন। আপনারা মূল কাজটি সম্পন্ন করেছেন; এখন সামান্য পথ বাকি। সবকিছু নির্ভর করছে শেষ অংশটুকুর ওপর। তিনি যোগ করেন, ভেতরে কোনো রকমের দুশ্চিন্তা রেখে আমাদের যেন নির্বাচনে ঢুকতে না হয়। উৎসব এখান থেকে শুরু হবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধেই হবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আলাদিনের চেরাগের দৈত্য হাতে এনে দিয়েছে- মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা কোনো বিষয় ছোট আকারে না রেখে, এই জাতিকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তৈরি করে দিয়ে যাব। এ সুযোগটা এসেছে। সেখানে ছোটখাটো বিষয়ের মধ্যে আটকে গিয়ে আমরা যেন মূল বড় জিনিস হারিয়ে না ফেলি।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন কোনোভাবেই একটি আরেকটির ওপর সম্পর্কিত নয়। সংস্কার সংস্কারের মতো চলবে, এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিচারেও সময় বাধা যায় না। তাহলে অবিচার হবে। সেটা চলবে, যে সরকারই আসুক। কিন্তু নির্বাচনকে শর্তসাপেক্ষ (কন্ডিশনাল) করা যাবে না। নির্ধারিত সময়কালে নির্বাচন হতেই হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও তা হুমকি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কিনা- এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিমকোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। এর বাইরে কিছু থাকলে জানান, আমরা একমত। আগেও বলেছি, আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা কম্প্রোমাইজ করব। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো পন্থা বের করতে পারলে তাতে একমত হব। প্রস্তুত করা চূড়ান্ত জুলাই সনদে ক্লারিক্যাল মিসটেক ও কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। এটা আমরা কারেকশন করে দেব। এটি জাতীয় দলিল, রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, ঐতিহাসিক দলিল হবে। সেজন্য নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়। যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়নি, সেগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে না। বিতর্ক যত কম করা যায়।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না। সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো নাগরিক যদি এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, সেটা আপনার (ড. ইউনূসের) গ্লোবাল রেপুটেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।

দলের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নের দুটি উপায়ের কথা তুলে ধরে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, একটি হলো প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার। অতীতে এটার নজির আছে। আরেকটি হলো গণভোট। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে মানুষ রায় দেবে।

কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান ও নতুনভাবে লিখিত ধারা-উপধারা ও অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে সংশোধনী ও সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছি, সেগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে।

এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ফের সভা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল রবিবার সকালে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।

কমিশন সূত্র জানায়, সভায় সনদ বাস্তবায়ন সম্পর্কিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অবহিত করা হয়। পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পূর্বে প্রাপ্ত সুপারিশমালাও আলোচনায় ওঠে আসে। সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন বিশেষজ্ঞরা।