ডায়ালাইসিস মোটেই আতঙ্ক নয়, একটি চিকিৎসা পদ্ধতি মাত্র

অধ্যাপক ডা. মো. মাকসুদুর রসুল
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ডায়ালাইসিস মোটেই আতঙ্ক নয়, একটি চিকিৎসা পদ্ধতি মাত্র

ESRD বা End-Stage Renal Disease হলো কিডনি রোগের সর্বশেষ পর্যায়, যখন কিডনি তার ৮৫-৯০ শতাংশ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি অপসারণ করতে অক্ষম হয়। তখন জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপন। অনেকেই মনে করেন, ডায়ালাইসিস মানে জীবনের অবসান, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি জীবনের একটি নতুন অধ্যায়।

ডায়ালাইসিস শুরু করার আগে রোগী ও পরিবারের সদস্যদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়- আমি নিয়মিত চিকিৎসা নিয়েছি, তাও কেন ডায়ালাইসিস লাগবে? সারাজীবন কি এভাবেই চলবে? এটা কি কষ্টদায়ক? আমি কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব? খরচ কত? কোন পদ্ধতি উপযুক্ত ইত্যাদি। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়ালাইসিস এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি, এর মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত তরল বের করে দেওয়া হয়। এটি মূলত দুভাবে করা যায়- হেমোডায়ালাইসিস ও পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস। হেমোডায়ালাইসিসে রক্তকে শরীরের বাইরে এনে একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়। এতে সাধারণত সপ্তাহে ২-৩ দিন, প্রতিবার ৪ ঘণ্টা সময় লাগে এবং AV ফিস্টুলা বা ক্যাথেটার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিসে পেটের ভেতরের প্রাকৃতিক পর্দা ব্যবহৃত হয়। এটি রোগী নিজেই বাসায় প্রতিদিন কয়েকবার তরল ঢুকিয়ে ও বের করে সম্পন্ন করতে পারেন।

ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় তখনই, যখন কিডনি শরীর থেকে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, অতিরিক্ত লবণ ও পানি ইত্যাদি ঠিকভাবে বের করতে পারে না। ফলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমে গিয়ে দেখা দেয় মুখমণ্ডল বা শরীর ফুলে যাওয়া, দুর্বলতা, বমি, শ্বাসকষ্ট, প্রস্রাব কমে যাওয়া, এমনকি খিঁচুনি বা হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো মারাত্মক সমস্যা। তখন ডায়ালাইসিস ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।

রোগীর জন্য কোন পদ্ধতি উপযুক্ত হবে তা নির্ভর করে তার বয়স, শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য অসুখ, কর্মজীবন, পারিবারিক সহায়তা এবং বাসার অবস্থানের ওপর। সাধারণত হেমোডায়ালাইসিস হাসপাতালে করতে হয় আর পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বাসায় করা যায়। হেমোডায়ালাইসিস সপ্তাহে ২-৩ বার হলেও পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস প্রতিদিন কয়েকবার করতে হয়। রোগী যদি গ্রাম বা দূরবর্তী এলাকায় থাকেন, পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস সুবিধাজনক হতে পারে। তবে হার্ট ফেইলিউর থাকলে হেমোডায়ালাইসিস ঝুঁকিপূর্ণ, আবার পেটে আগে কোনো অপারেশন থাকলে পারিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস করা কঠিন।

ডায়ালাইসিস শুরুর পর খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমনÑ প্রোটিনের পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো হয়Ñ প্রতিদিন ১.২ থেকে ১.৪ গ্রাম/কেজি ওজন অনুসারে, তবে সোডিয়াম (লবণ), পটাশিয়াম (যেমনÑ কলা, আলু, টমেটো), ফসফরাস (যেমনÑ দুধ, বাদাম, ডাল) ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়। পানি নির্ধারিত পরিমাণের বেশি পান করা যাবে না। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে, যেমন ফসফেট বাইন্ডার, আয়রন, ভিটামিন ডি ইত্যাদি। ডায়ালাইসিসের জন্য মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক ও আর্থিকভাবে প্রস্তুতি প্রয়োজন। ডায়ালাইসিস দুর্বল নয়, সুস্থ রাখেÑ আত্মবিশ্বাস গড়তে হবে। কাউন্সেলিং, অন্য রোগীর অভিজ্ঞতা, পারিবারিক আলোচনা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

লেখক : মেডিসিন ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ/ চেম্বার : আলোক হাসপাতাল, মিরপুর-৬, ঢাকা/ হটলাইন : ১০৬৭২, ০৯৬১০১০০৯৯৯