অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রের টেকসই ভিত্তি

শেখ রফিক
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রের টেকসই ভিত্তি

‘আপনার ভোট হয়ে গেছে, আপনি যেতে পারেন।’ ‘না, আমি তো এখনও ভোট দিইনি, দিতে এসেছি।’ ‘বললাম না, আপনার ভোট হয়ে গেছে- দুরু মিয়া, চলে যান।’ এই সংলাপের মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক গভীর সংকটের বাস্তবতা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো সেই শিক্ষাই দিয়েছে। এই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর বর্জন, ভোটাধিকার হরণ এবং রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতিত্বের ফলে গণতন্ত্র ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে। জনগণের রাজনৈতিক আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সমাজ বিভাজিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রধান দাবি হয়ে ওঠে- একটি অন্তর্বর্তী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, বিশ^স্ত এবং আস্থাশীল।

গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হলো জনগণের অংশগ্রহণ। ন্যায়বিচার, জবাবদিহি এবং দেশের সব নাগরিকের অধিকার ও উন্নয়নের পথ উন্মুক্ত করার অন্যতম মাধ্যম নির্বাচন। কিন্তু যদি সমাজের একাংশকে বাইরে রাখা হয়, ভোট-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত বা বিকৃত হয়, তাহলে নির্বাচন হয়ে যায় শুধু নামমাত্র কাঠামো, যেখানে জনগণের স্বীকৃতি, আস্থা এবং অংশগ্রহণ থাকে না।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে বোঝায়- নারী, যুবক, শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেণির মানুষ যেন ভয়ভীতিমুক্তভাবে ভোট দিতে এবং মত প্রকাশ করতে পারে। ভোটাধিকার সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করে, রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে এবং নাগরিক-রাষ্ট্র সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, একপক্ষীয় বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন আস্থা আনতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক সংঘাত ও বিভাজনকে আরও গভীর করে। গবেষণা দেখিয়েছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত, সেখানে উন্নয়ন টেকসই হয়, সংঘাত কমে এবং জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে অনুভব করে। মার্ক্সের মতে, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃত ক্ষমতা শুধু শক্তিধর সংস্থা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। হ্যানস কেলসেনও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেছেন, আইন ও সংবিধান কার্যকর হওয়ার জন্য জনগণকে সেই ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করতে হয়, অন্যথায় তা কেবল শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রধান শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এটি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে পারে।

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন ২৪ দফা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আসন সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, আইন সংস্কার এবং পর্যবেক্ষক অনুমোদন- সব মিলিয়ে এটি বিস্তৃত রোডম্যাপ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে, রোজার আগে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন; ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ঘোষণা করা হবে তফসিল।

যদি এই রোডম্যাপ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়িত হয়, বাংলাদেশ নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ে প্রবেশ করবে। জনগণের আস্থা পুনর্গঠিত হবে, রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক শক্তিশালী হবে। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও বাংলাদেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা ফিরে পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, অভ্যুত্থানের রক্তে শুরু হওয়া গণতন্ত্রের যাত্রা তখন ধীরে ধীরে স্থায়ী রূপ নেবে। তবে এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। প্রতিটি ধাপে তথ্য উন্মুক্ত রাখতে হবে জনগণ ও গণমাধ্যমের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা হবে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। কোনো দলকে সুবিধা বা বঞ্চনা দেওয়া মানে আস্থার সংকট তৈরি করা। রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, কেবল দাবি নয়, অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে সক্রিয় করতে হবে প্রচারণা, উদ্বুদ্ধকরণ ও নাগরিক সচেতনতার মাধ্যমে।

তারেক রহমান যথার্থই বলেছেন, ‘নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই, নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প।’ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান যে আত্মত্যাগ এনেছে, তার সর্বোচ্চ অর্জন হতে পারে কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণভিত্তিক সরকার; যে সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বত্র জনগণের অংশীদারত্ব, অধিকার, ন্যায়বিচার, সমতা, মর্যাদা, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করবে।

২০২৫ সালের ৪ জুন ঢাকায় ডিক্যাব আয়োজিত আলোচনায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস স্পষ্ট ভাষায় বলেন- জাতিসংঘের কাছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মানে হলো নারী, যুবক, নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ প্রত্যেক নাগরিকের ভয়ভীতিমুক্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তিনি আরও স্মরণ করিয়ে দেন, জাতিসংঘ কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে না, কারণ সব দলের অংশগ্রহণ সমাজে মেরুকরণ কমায় এবং সংঘাত প্রতিরোধ করে।

কিন্তু বাস্তবতায়, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর প্রেক্ষাপটে, ২০২৫ সালের মে মাসে সরকার দলটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের যুক্তি হলো- দলটি সক্রিয় থাকলে বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়তে পারে এবং অতীতের মতো প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে। এ জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রকাশ্য বক্তব্য, প্রচারণা বা জনসমাবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।

সরকার বলেছে, এটি সাময়িক সিদ্ধান্ত, শুধু বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন, সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত সংগঠন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও বলে- ‘দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাই নির্দোষ।’ অভিযোগের ভিত্তিতে দল/কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা সেই নীতির পরিপন্থি। ইতিহাসও আমাদের শিক্ষা দেয়। ১৯৭৫ সালে বাকশালের মাধ্যমে দলনিরোধ গণতন্ত্রের অবসান ঘটায়, দেশ অস্থিতিশীল হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। আবারও ২০১৩ সালে জামায়াত ও ২০২৪ সালে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের উদাহরণ বিতর্কিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ এখন সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়বে। বিএনপি ইতোমধ্যে তাদের ৩১ দফা রূপরেখা ও ভিশন-২০৩০-এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার। আজকের বাস্তবতায় সেটিই একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক রূপান্তরের ভিত্তি।

আজকের বাংলাদেশে- ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান, এর পরের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি, দল নিষিদ্ধকরণ- সবকিছু মিলিয়ে একটি প্রশ্ন এখন মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে : বাংলাদেশ কি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে?

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল বারবার বলছে- একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিম-লে আস্থা পুনর্গঠন করতে পারবে না। বিদেশি বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, এমনকি মানবাধিকার ইস্যুতেও এর প্রভাব পড়বে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র কেবল কাগজে থাকবে, বাস্তবে থাকবে দমননীতি, অবিশ^াস আর অস্থিরতা। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে জনগণ আবারও রাষ্ট্রকে নিজের মনে করবে, উন্নয়ন টেকসই হবে, সমাজে শান্তি ও আস্থা ফিরবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রের টেকসই ভিত্তি- বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। জনগণই রাষ্ট্রের মালিক, আর নির্বাচনের মাধ্যমেই সেই মালিকানার স্বীকৃতি হয়। তাই সবার জন্য সমান সুযোগ, সবার অংশগ্রহণ ও সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করাই হবে টেকসই গণতন্ত্রের একমাত্র পথ।

আজ সময় এসেছে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে- বাংলাদেশ কি তার অতীত ভুল কাটিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে এগোতে পেরেছে, নাকি আবারও নামমাত্র গণতন্ত্রের কুয়াশায় হারিয়ে যাবে? বাংলাদেশ এখন সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।


শেখ রফিক : গবেষক ও কলাম লেখক