শেষদিনে প্রচারের উৎসব
শপথ নিলেন ছাত্রদল মনোনীত প্রার্থীরা, ৮ অঙ্গীকার # ১০ দফা দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের # নিজেদের জয়ী বললেন প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস মেঘমল্লার বসু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আগে শেষ দিনের প্রচারণায় সরব ছিল সব পক্ষ। এদিন ঐতিহাসিক বটতলায় শপথ নেয় ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও শিক্ষার্থীবান্ধব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার শপথ নেন পরিষদটির প্রার্থীরা। একই দিনে প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু হাসপাতালে থেকে সরাসরি ক্যাম্পাসে এসে জানিয়েছেন, ফল যাই হোক, জয় তাদেরই হয়েছে। এ ছাড়া দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে ১০ দফা দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সব মিলিয়ে গতকাল রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রচারণার শেষ দিনটি কাটে নানা কর্মসূচিতে।
শপথ নিল ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল : ছাত্রদল সমর্থিত আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদের প্রার্থীরা গতকাল দুপুরে সাম্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার শপথ নিয়েছে। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ কর্মসূচি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন ঐতিহাসিক বটতলায় শপথবাক্য পাঠ করান ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। শপথে গণরুম-গেস্টরুম প্রথা না ফেরানো; গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও
জনগণের মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া; নারী শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা; বৈধ আসনের ব্যবস্থা, সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা; সহজ-সুবিধাজনক পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; অনলাইনে সুরক্ষা এবং শিক্ষা-গবেষণা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিসহ ৮টি অঙ্গীকার করা হয়।
শপথপাঠ শেষে আবিদুল ইসলাম খান বলেন, আমরা আশা করব একটি সফল ডাকসুর প্রত্যাশা থেকে, একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যয় থেকে, আপনারাও আমাদের এই শপথের অংশীদার হবেন। আমাদের প্যানেলের প্রতিটি প্রার্থীকে আপনার মূল্যবান ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন। আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ও প্যানেলকে ভোট দিই। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।
প্রতিরোধ পর্ষদের সংবাদ সম্মেলনে মেঘমল্লার বসু : প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতাল থেকে সরাসরি আসেন মধুর ক্যান্টিনে। শুরুতে তিনি সদ্য প্রয়াত লেখক-গবেষক ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বদরুদ্দিন উমরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ৯ তারিখে নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, আমরা ইতোমধ্যেই জিতে গিয়েছি। কারণ বাংলাদেশে যখন আমরা দেখতে পাই একটার পর একটা মাজার ভাঙা হয়, মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, একটার পর একটা মব আক্রমণ হয়, মোরাল পুলিশিং হয়, তখন আমাদের উপস্থিতির কারণে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোকেও বলতে হচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেয়েদের হল রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে, ধর্মকেন্দ্রিক বিভাজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে না। সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও লড়াইয়ের প্রেরণা জোগাতেই ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছেন বলে জানান মেঘমল্লার।
এ ছাড়া সব শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়ে মেঘমল্লার বলেন, আপনারা যাকে খুশি তাকে ভোট দিন, কিন্তু ৯ তারিখে ভোট দিতে আসুন। আপনারা ভোট দিতে আসলে সব সমীকরণ বদলে যাবে। এখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের একটা পোস্টও উঠে আসতে পারবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১০ দফা : ডাকসু নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। গতকাল রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ছিল নারী ভোটার যাচাইয়ে নারী শিক্ষকের দায়িত্ব, বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নির্দেশনা, পর্যবেক্ষকের বিশ্রামকক্ষ এবং প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
পরে বিকালে ঐতিহাসিক বটতলায় ‘ডাকসু প্রার্থীদের ভাবনা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তির লড়াই’ শীর্ষক এ আলোচনাসভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এতে বর্তমান প্রার্থীদের পাশাপাশি সাবেক ডাকসু নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ছাত্ররা বরাবরই বড় বড় অর্জনের সূচনা করেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন- সবকিছুতেই তাদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক দল যেখানে দ্বিধা করেছে, সেখানে ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্র সংসদে আসবেন তারা, যারা দেশের গৌরব-ঐতিহ্যকে সম্মান করবেন। আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে শহীদের রক্তের যথাযথ মূল্যায়ন কীভাবে করা যায়, সংস্কার কীভাবে সম্পন্ন করা যায়, আর লুটপাটের বিচার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। আপস নয়, দৃঢ়তার সঙ্গে পথ চলতে হবে।
ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, অতীতে ছাত্ররাজনীতি ছিল আন্দোলন ও আদর্শের জায়গা। কিন্তু পরে বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাব, দখলদারিত্ব, লাঠিয়াল রাজনীতি শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। ফলে আজ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে যারা আদর্শিক রাজনীতি করে বা রাজনৈতিক দলের অন্যায় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থেকে ছাত্রদের স্বার্থরক্ষা করতে পারবে, তারাই সফল হবে। আমার বিশ্বাস, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক চেতনা ধারণকারী ছাত্ররাই আগামীতে নেতৃত্বে আসবে।
এ সময় এবাবের ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরাও তাদের ভাবনা তুলে ধরেন। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, আমরা রাজনীতি শিখেছি কোনো বই থেকে নয়, ফ্যাসিবাদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও দুঃশাসন মোকাবিলা করে। আমাদের প্রজন্ম রাজপথে দাঁড়িয়েই রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আজকের অবস্থানে এসেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন একটি স্থান, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে গড়ে উঠবে।
প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু বলেন, জুলাইজুড়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে স্লোগান দিয়েছি। ৫ আগস্ট গণভবনের উদ্দেশে ছাত্র-জনতা যে বিশাল ব্যানার নিয়ে রওনা দেয়, তাতে লেখা ছিল আমার লেখা লাইন- ‘স্বৈরাচারের হয়নি পতন, মুক্তিযুদ্ধ হয়নি শেষ; গর্জে ওঠো বীর জনতা, গর্জে ওঠো বাংলাদেশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যার সঙ্গে, গণধর্ষণের সঙ্গে, শহীদের স্মৃতির সঙ্গে কি সহাবস্থান সম্ভব? অনেকের কাছে হয়তো এই ইস্যু ক্ষুদ্র, বাড়াবাড়ি। কিন্তু আমরা এমন প্রজন্ম, যারা আজাদের মায়ের গল্প শুনে বড় হয়েছি, যিনি ছেলেকে হারিয়ে আর ভাত খাননি। ৯ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে কী হবে জানি না, কিন্তু জানি বাংলাদেশের মাটি থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার বা শহীদদের স্মৃতিকে ম্লান করার যে কোনো প্রচেষ্টা আমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়েই যাবে।’