শিশুর ডাউন সিনড্রোম রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক রোগ, যা মানবদেহে ক্রোমোজোমের বিশেষ ত্রুটির জন্য হয়ে থাকে। সাধারণত একটি শিশু ৪৬টি (২৩ জোড়া) ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মায়। ২১তম জোড়া ক্রোমোজোমের সাথে অতিরিক্ত ক্রোমোজোম (তৃতীয় কপি) উপস্থিত থাকলে ক্রোমোজোমের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭। এ জেনেটিক অসমতাই ট্রাইজোমি ২১ বা ডাউন সিনড্রোম।
বিশ্বে প্রতি ৭০০ শিশুর মধ্যে জন্ম নেয় একটি ডাউন সিনড্রোম। স্বতন্ত্র শারীরিক গঠন, শিশু বিকাশে বিলম্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কারণ : চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ অবস্থার সুনির্দিষ্ট কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
যাদের ঝুঁকি বেশি : বেশি বয়সে মা হয়েছেন (>৩৫ বছর)Ñ এমন নারীর সন্তানের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়। যেসব বাবা-মায়ের ইতোমধ্যে এমন সন্তান রয়েছে, তাদের পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে এ জেনেটিক ঝুঁকি থেকে যায়।
আরও পড়ুন:
শীতে গর্ভবতী মায়েদের যত্ন
লক্ষণ ও জটিলতা : এদের দেখতে প্রায়ই একই রকমের মনে হয়। আচরণে মিল থাকতে পারে। তবে প্রত্যেকের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট থাকে। যেমনÑ ছোট মাথা, চ্যাপ্টা মুখ, ছোট নাক, চোখের কোণ ওপরের দিকে তোলা, প্রসারিত জিহ্বা, অস্বাভাবিক ছোট কান, ছোট গলা, হাতের তালুতে একটি রেখা এবং অপেক্ষাকৃত ছোট আঙুল, ছোট হাত ও পা। এদের শরীরে মাংসপেশি দুর্বল হয় বলে খুব নরম তুলতুলে হয়। কম উচ্চতা, কানে কম শোনা, কথা বলতে দেরি, শিশু বিকাশ বাধাগ্রস্থ হওয়া ইত্যাদি জটিলতা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে হার্টে জন্মগত ত্রুটি থাকে। নানাবিধ আন্ত্রিক সমস্যা, রক্তরোগ, খিঁচুনি, বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা এবং কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, শরীর স্থূল হতে পারে। পাশাপাশি তাদের আইকিউ (বুদ্ধিমত্তা) সাধারণত গড় মানের নিচে থাকে। ফলে স্বাভাবিক শিক্ষার ধারা ধীর গতির হয়ে থাকে। কিছু শিশুকে স্বাভাবিক বিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেওয়া হলেও কিছু ক্ষেত্রে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দিতে হয়। কেউ কেউ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চমাধ্যমিক এবং এর ওপরেও পড়াশোনা করে।
পছন্দ : এসব শিশু মিশুক প্রকৃতির, খুব নাচতে পছন্দ করে, গান গাইতে ও শুনতে এবং ছবি আঁকতে পছন্দ করে। এদের মধ্যে খাবার অনীহা দেখা যায়। কেউ কেউ খেতে পছন্দ করে। একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে ভিন্ন কিছু তাদের পছন্দ।
শনাক্তকরণ : প্রাথমিকভাবে শিশুর মুখের চেহারার পর্যবেক্ষণ করে এ রোগ শনাক্ত করা হয়। তার পর ক্রোমোজোম বিশ্লেষণের জন্য ক্যারিয়োটাইপিং নামক রক্ত পরীক্ষা দ্বারা ডাউন সিনড্রোম ক্রোমোজম ২১-এর অতিরিক্ত অনুলিপি নিশ্চিত করা হয়। তাছাড়া গর্ভবস্থায় ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্মের ঝুঁকি শনাক্ত করতে কিছু স্ক্রিনিং পরীক্ষা ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে। গর্ভাবস্থায় ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত হলে গর্ভপাতের পরামর্শ দেওয়া হয়।
চিকিৎসা : ডাউন সিনড্রোমের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেইঅ তবে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক চিকিৎসা (থেরাপি) খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ শিশুরা কয়েক ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তাই জন্মের পর থেকে নিবিড় যত্নের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। মোটকথা, যত্ন যত বেশি প্রারম্ভিকে শুরু করা যাবে, ততই দ্রুত শিশু স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের কাউন্সিলিং জরুরি। ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং জটিলতাভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে অবস্থাটি সামলানো যায়। বিশেষায়িত স্কুল, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিশেষ খেলাধুলাসহ একটি সহায়ক পরিবেশ এই শিশুর মানসিক অবস্থায় উন্নয়ন ঘটায় এবং তাদের সম্ভাবনাগুলো সর্বোচ্চ মাত্রায় পূর্ণ করতে সাহায্য করে।
লেখক : অধ্যাপক, শিশু বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
চেম্বার : আলোক মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার, মিরপুর -৬ ঢাকা
আরও পড়ুন:
জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণগুলো জেনে রাখুন
হটলাইন : ১০৬৭২