স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কতটা কার্যকর

ডা. মো. সাইদুর রহমান
১৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কতটা কার্যকর

স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসনে ফিজিওথেরাপি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর চিকিৎসা। এর মাধ্যমে রোগী পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আসতে পারেন। স্ট্রোক সাধারণত হঠাৎ করেই হয়। মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে ইসকেমিক স্ট্রোক এবং রক্তনালি ফেটে গিয়ে রক্তপাত হলে হেমোরেজিক স্ট্রোক এই জটিলতা তৈরি করে। এতে রোগীর শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যেতে পারে, মুখ বেঁকে যেতে পারে, কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, চলাফেরা ও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং রোগী সম্পূর্ণভাবে পঙ্গুত্ববরণ করতে পারেন। এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসার দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, রোগ নির্ণয় ও তাৎক্ষণিক চিকিৎসা (মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্ট); দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন বা রিহ্যাবিলিটেশন। এর মূলে রয়েছে ফিজিওথেরাপি।

অনেক সময় দেখা যায়, রোগী প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা স্থিতিশীলতা লাভ করেন। ফলে পরে সঠিক ফিজিওথেরাপির গ্রহণ না করায় স্বাভাবিক চলাফেরা বা দৈনন্দিন কাজের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। অথচ গবেষণায় প্রমাণিত, সময়মতো এবং সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর ৭০-৮০ শতাংশ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আগের জীবনে ফিরে যেতে পারেন। ফিজিওথেরাপি একদিকে যেমন শরীরের অবশ পেশিকে সচল করে, তেমনি অন্যদিকে স্নায়ুর সঙ্গে শরীরের মেলবন্ধন নতুনভাবে তৈরি করে মস্তিষ্কের পুনর্গঠন (neuroplasticity প্রক্রিয়া উৎসাহিত করে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের সুস্থ অংশগুলো প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশের কার্যভার নিতে উৎসাহিত করে।

ফিজিওথেরাপির চিকিৎসা পদ্ধতি কোনো একক জাদু নয়। এটি ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া কাঠামোবদ্ধ চিকিৎসা। এর মধ্যে রয়েছে ব্যায়ামভিত্তিক থেরাপি (প্যাসিভ ও অ্যাকটিভ এক্সারসাইজ), ভারসাম্য ও সমন্বয় উন্নয়ন (ব্যালান্স ও কো-অর্ডিনেশন ট্রেনিং), হাঁটা শেখানো (গেইট ট্রেনিং), হাত-পায়ের ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ (ফাংশনাল রিহ্যাবিলিটেশন), স্পাস্টিসিটি বা পেশি জড়তা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে ইলেকট্রোথেরাপি। যেমন ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন বা টেনস থেরাপি। এছাড়া অস্বাভাবিক অঙ্গসঞ্চালন বা ব্যথা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয় থেরাপিউটিক টেকনিক। যেমনÑ ম্যানুয়াল থেরাপি বা পজিশনিং।

এখানে সময় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্রোকের পরে প্রথম তিন মাসকে বলা হয় গোল্ডেন পিরিয়ড। এ সময়ের মধ্যে ফিজিওথেরাপি শুরু করা হলে রোগীর উন্নতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। অনেকে ভাবেন, রোগী একেবারে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ব্যায়াম শুরু করবেন। কিন্তু বাস্তবে যত দ্রুত থেরাপি শুরু করা যায়, তত ভালো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপিস্টদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে, রোগীর শারীরিক অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী একটি থেরাপি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। শুরুতে হয়তো শুধু পেশিকে সচল রাখার জন্য প্যাসিভ মুভমেন্ট দেওয়া হয়। পরে রোগী নিজে ব্যায়াম করতে পারেন এমন অবস্থায় পৌঁছালে অ্যাকটিভ মুভমেন্ট চালু করা হয়। এর পাশাপাশি হাঁটার প্রশিক্ষণ, দাঁড়ানোর কৌশল, ভারসাম্য রক্ষা এবং নিজের কাজ নিজে করার মতো কার্যকরী থেরাপিগুলোও ধাপে ধাপে যুক্ত হয়।

ফিজিওথেরাপির একটি বড় সুবিধা হলো, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও সাইড-ইফেক্টবিহীন চিকিৎসা। তবে এতে ধৈর্য, নিয়মিত অনুশীলন এবং পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। স্ট্রোকে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। হতাশা, উদ্বেগ ও নিজেকে পরিবারের বোঝা ভাবা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা দেখা যায়। তাই শারীরিক চিকিৎসাই নয়, রোগীর মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : চিফ কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান; রি-অ্যাক্টিভ ফিজিওথেরাপি সেন্টার, ফনিক্স টাওয়ার, শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ এভিনিউ, তেজগাঁও, ঢাকা। ০১৭১৬৪৫৩২০৫; ০১৯১৪০০৪৫২৪