২৪ ফেরত দিয়েছে ৭১-এর মালিকানা
‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর ‘গণ-অভ্যুত্থানের’ মাঝের পার্থক্যটা অনেকে গুলিয়ে ফেলে বলে একটি অযাচিত বিতর্কের অবতারণা ঘটে। তবে দুটি সংগ্রামের মাঝে মিল হলো, আমরা দুটি রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দুটি দেশের আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। ৭১ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ২৪ আমাদের গণ-অভ্যুত্থান। দুটি সুনির্দিষ্ট এবং মীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। অতি আবেগে কেউ কেউ যখন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর গণ-অভ্যুত্থানের’ মাঝের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে তখন পরাজিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা এটাকে অ্যানার্কি সৃষ্টি করতে ব্যবহার করে।
৭১ এবং ২৪ এই ভূখণ্ডের জীবনে নিঃসন্দেহে অনেক বড় দুটি ঘটনা। ৭১-এ আমরা পেয়েছিলাম ভূখণ্ডের মালিকানা, কিন্তু আমরা সে মালিকানাকে নিরঙ্কুুশ করতে পারিনি। ভারতীয় আধিপত্যবাদ ধীরে ধীরে আমাদের সেই মালিকানা কেড়ে নিয়ে আমাদেরকে তাদের গোলামে পরিণত করেছিল। হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল মূলত ভারতের গোলামির বিরুদ্ধে লড়াই। হাসিনার পতনের ভেতর দিয়ে এ দেশে কবর রচিত হয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের, মূলত পরাজয় ঘটে নব্য হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের।
ভারতীয়দের প্রথম ব্যর্থতা ছিল বাকশালি মুজিবের পতনের ভেতর। তারা থেমে থাকেনি। সুদীর্ঘ পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে তারা স্বৈরাচার মুজিবের কন্যাকে ফ্যাসিস্ট হাসিনায় পরিণত করে। হাসিনার পতনের পর এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীর পর এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সুযোগ এসেছে দেশের মালিকানার নিরঙ্কুুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। আমাদের কঠিনভাবে সতর্ক থাকতে হবে, এই সুযোগ আর কোনোভাবেই যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়। আমাদের যুদ্ধ আর সংগ্রামগুলো জাতি হিসেবে আমাদেরকে যেমন সাহসী ও সম্মানিত করেছে, বিপরীতে জাতির সঙ্গে বেইমানি ও বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দুর্নামও রয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই মুজিব তার শাসনকালকে সারাজীবনের জন্য কুক্ষিগত করে রাখতে হেন কোনো কুকর্ম নেই যা করেননি।
আরও পড়ুন:
ঠাকুরগাঁও : স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন
মুজিব তার নিজস্ব রক্ষীবাহিনী দিয়ে নিজ দেশের ত্রিশ হাজার তরুণ-যুবক জাসদকর্মীকে হত্যা করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য পাঠানো আন্তর্জাতিক সাহায্যগুলো ভারতে পাচার করে দিয়ে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেন, যার ফলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। আর ছিল ভারতের সঙ্গে বশ্যতা ও গোলামির গোপন চুক্তি, যেসব চুক্তি মূলত বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করে। আর মুজিব পরিণত হন সেই রাজ্যের চুক্তিভিত্তিক সামন্ত রাজা। মুজিবের এসব কর্মকাণ্ডে তার পতন নিশ্চিত ছিল, দেশের ভেতর মানুষের ক্ষোভ-ক্রোধ দানা বেঁধে অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর হাতে মুজিব-শাসনের পতন ঘটে।
ভিতু ভারতীয়রা জানে, যুদ্ধে এই জাতিকে তারা পরাভূত করতে পারবে না। তাই তারা মনোযোগ দেয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে। তারা মন-মগজ ধোলাই করে একদল দাস তৈরি করে, যাদের কাজ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক সেক্যুলার সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে বৃহত্তর জাতীয়তাবোধের ভিত নড়বড়ে করে জাতিকে বিভক্ত করা। এই বিভক্তির কাজে তারা ব্যবহার করেছে মুক্তিযুদ্ধকে। তাদের যেকোনো অপকর্মের বিরোধিতা করা মানেই ছিল যেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ১৬ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই ভারতীয় বয়ান দ্বারা অনাচার করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত আমরা তার ন্যারেটিভ দিয়েই তাকে প্রতিহত করেছিলাম এই বলে যে- ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।”
আরও পড়ুন:
একের পর এক আক্রমণে দিশাহারা পাকবাহিনী
হাসিনার পতনের ভেতর দিয়ে ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট দ্বিতীয়বারের মতো এবং শেষবারের মতো ফেল করল এ দেশে।
২৪-এর জুলাই আমাদের ফেরত দিয়েছে ৭১-এর নিরঙ্কুুশ মালিকানা। এখান থেকেই শুরু ভবিষ্যৎ স্বনির্ভর বাংলাদেশের নবযাত্রা। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে পিন্ডি দিল্লি ওয়াশিংটন বেইজিং- কেউই আমাদের সঙ্গে ছিল না। সারা পৃথিবীকে অবজ্ঞা করে আমরা খালি হাতে হাসিনার রাইফেলের বিরুদ্ধে লড়েছি। এমন অর্জন কোনো জাতির জীবনে বারবার আসে না, এই অর্জনের সঙ্গে কেউ বেইমানি করার চেষ্টা করলে তাদের মনে রাখা উচিত হবে- বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দেশের জন্য শহীদ হতে শিখে গেছে। আর কোনো ফ্যাসিস্ট, আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না এই বাংলাদেশে।
আরও পড়ুন:
সেলুলয়েডের ফিতায় মুক্তিযুদ্ধ