জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক
শিক্ষক হিসেবে আমরা জুলাইয়ের শুরু থেকে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখছিলাম। যেহেতু এটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল, তাদের চাকরিতে অধিকার পাওয়ার বিষয় ছিল, সেজন্য এর মধ্যে আসলে আমরা যুক্ত হতে চাইনি। কারণ কথায় কথায় উসকানিদাতা হিসেবে নিপীড়নের মধ্যে পড়ার ব্যাপার ছিল। আর ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম যখন, শিক্ষার্থীরা তখন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন তখনকার প্রধানমন্ত্রী সমস্ত কোটা বাতিল করে দেন, তখন সেটা কত যে অযৌক্তিক এবং অর্বাচীন কাজ হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বিবৃতিও দিয়েছিলাম। কারণ এটি অসাংবিধানিক। বাংলাদেশে অনগ্রসর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সংবিধানেই আছে। আর পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশেই এ ধরনের অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন থাকার কথা।
ফলে প্রথমত কোটাবিরোধী আন্দোলন, তার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন চলছিল, তখন ইউটিএন সংযুক্ত ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময় যখন পনেরো তারিখ থেকে এ আন্দোলনের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও অন্যান্য লীগের হামলা শুরু হলো, পরে পুলিশ যুক্ত হয়ে আবু সাঈদসহ ছয়জনকে হত্যা করল, তার পর আসলে আমাদের পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকাটা সম্ভব হয়নি।
১৬ তারিখ বিকালেই আমরা ইউনিভার্সিটি টিচার্স নেটওয়ার্কের কয়েকজন সদস্য- আমি, সৌম্য সরকার, তানজীমউদ্দিন খান, দীপ্তি দত্ত, তাসনিম সিরাজ মাহবুব, রুশাদ ফরিদী ও আবদুল মান্নান- আমরা ক্যাম্পাসে জড়ো হই এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যাই। কারণ ওখানে তখনও আমাদের আহত ছাত্ররা ছিলেন। তাদেরকে দেখতে যাই, কিন্তু আমরা সেদিন যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন বুঝতে পারি যে, অলরেডি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা শুরু হয়েছে। ১৫ তারিখ রাতেই নেটওয়ার্কের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, সতেরো জুলাই অপরাজেয় বাংলার সামনে একটা সমাবেশ করা হবে। সেই সমাবেশ করতে গিয়ে আমরা কয়েকজন ছাত্রকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম- একজনকে দিয়েছিলাম মাইক্রোফোনের দায়িত্ব, আরেকজনকে দিয়েছিলাম ব্যানার লেখার দায়িত্ব। যাদেরকে ব্যানার লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তারা আবার ১৬ তারিখ সারাদিন ও রাত পর্যন্ত আহতদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার কারণে ব্যানারটা লিখতে পারেনি।
সতেরো জুলাই ছিল আশুরা। ফলে আশুরার দিন সকালবেলা যখন আমরা সমাবেশের জন্য তৈরি হচ্ছি, সাতটা, সাড়ে সাতটার দিকে আমরা জানতে পারি যে, ওরা রঙ জোগাড় করতে পেরেছে, কিন্তু কাপড় জোগাড় করতে পারেনি। তারপর তারা একটা জায়গা থেকে কাপড় জোগাড় করে, সেই কাপড় নিয়ে লেখার মতো কোনো জায়গা নেই। কারণ চারদিকে পুলিশের ধর-পাকড়। কোথাও লিখতে দেখলে ধরে ফেলছে। তখন ওরা ওই কাপড় নিয়ে লেখার জন্য যখন তানজীম ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার চেষ্টা করে, ওদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, আটকে দেওয়া হয়। তানজীম ভাই নীলক্ষেত থেকে ওই দুটি ছেলেকে উদ্ধার করে ওনার বাসায় ওদের দিয়ে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’- এই কথাটুকু কোনো রকমে লিখে নিয়ে, সেই রঙ না-শুকানো অবস্থায় ব্যানারটি নিয়ে উনি এসে উপস্থিত হন অপরাজেয় বাংলার সামনে। আমাদের সমাবেশ শুরু, অথচ চারদিক থেকে আটকে দেওয়া হয় এবং ওই দিন সকাল থেকেই ওই এলাকায় কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না। ইন্টারনেট কানেকশন ওঠানামা করছিল। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা সমাবেশটি করি।
তাসনিম সিরাজ আপা এবং সাজ্জাদ সিদ্দিকী দুজন গিয়ে মাইক নিয়ে আসা ছেলেটিকে শাহবাগ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। আর এদিকে তানজীমউদ্দিন খান বাসা থেকে ব্যানার নিয়ে রওনা দেওয়ার আগে আমাকে জানান যে, একজন শিক্ষার্থী শাহবাগ থানায় আটক রয়েছে, আমাদের উচিত হবে ওখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করা। এর মধ্যে আমরা অনেকের সঙ্গে আলাপ করি। সবকিছু শুরু করতে দেরি হচ্ছিল। ওই দিন আসলে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে নেটওয়ার্ক ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের শিক্ষকরাও উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু এটা নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ, যে কেউ আসতে পারেন, তবে এটার আয়োজনে ছিল নেটওয়ার্ক। পরবর্তী সময় আমরা মিছিল করে শাহবাগ থানায় যাই এবং থানায় ঢোকার পর আমরা জানতে পারি যে, ওখানে আসলে দুজন ছাত্র আটক আছে। সেই দুজনকে নিয়ে আমরা বের হয়ে আসি। তার পর তাদেরকে নিয়ে মিছিল করেই অপরাজেয় বাংলায় আসা হয় এবং সেখানে আমাদের সমাবেশটি হয়। ১৮ তারিখে আমরা একটা বিবৃতি দিই। বিবৃতির সাতটি দাবির মধ্যে প্রথম চারটি আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম চারটি একই রকম। এই বিবৃতিটি যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইন্টারনেট একেবারে ডাউন হতে হতে তা-ও তখনও বোধহয় ভিপিএন দিয়ে চালানো যাচ্ছিল। একটু পর ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার পরও আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখি। আমরা ইউএনএইচআরসি ও ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনের কাছে একটা ইমেইল লিখি, যে ইমেইলটা ড্রাফট করেছিলাম আমি আর তানজীমউদ্দিন খান এবং সাহায্য করেছিলেন আসিফ নজরুল। সেই ইমেইলটা তানজীম ভাই প্রাথমিকভাবে ড্রাফট করার পর আমাকে সেটা ফোনে বলেন। ফোনে রেকর্ড করে সেখান থেকে ট্রান্সক্রাইব করে আমরা সেটা রেডি করি। তার পর আরেকজন ইউটিএনের সদস্য- আরাফাত রহমান, যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিল, সে ফোন করে এবং ইমেইলের টেক্সটটি আমরা রেকর্ড করি। সে ওটা ট্রান্সক্রাইব করে আবার লেখে। এ ছাড়া আসলে তখন তো ইমেইল ছিল না, কিছু ছিল না, কোনোভাবেই এটা পাঠানোর কোনো উপায় ছিল না। ফলে এই ছোট্ট কাজটুকু করতে আমাদের দুই-আড়াই দিন লেগে যায়। তার পর সেই ট্রান্সক্রাইব করা অডিও রেকর্ড থেকে আরাফাত একটা কিছু দাঁড় করায় এবং দেখে যে, ওখানে অনেক গ্যাপ আছে। যেহেতু তখন নেটওয়ার্ক অনেক খারাপ ছিল, প্লাস আমার বাসার আশপাশে অনেক সাউন্ড গ্রেনেড মারা হচ্ছিল, তাই অনেক জায়গায় কিছু শোনা যাচ্ছিল না। পরে সেই রাতে আবার তানজীম ভাইকে ফোন করে এবং তার কাছ থেকে এই গ্যাপগুলো ফিলআপ করে সে চিঠিটা লেখে। সেই চিঠিটা কিন্তু ইউকে পার্লামেন্টে লেবার পার্টির যে প্রতিনিধি বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করেছিলেন, তার কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে, এমনকি ইউএনের হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যাদের যাদের ইমেইল করা হয়েছিল, সেই ইমেইলটি আরাফাত রহমান ইউএসএ থেকে প্রত্যেককেই ইমেইল করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া গ্রিন পার্টির পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টেও এটি নিয়ে ডিসকাশন হয়। এ কাজটি আমরা করেছিলাম একটা খুবই অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে, খুবই গেরিলা কায়দায়।
ইন্টারনেট ফেরত আসার পর আমাদের যে সমন্বয়কদের দ্বিতীয়বার ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের ব্যাপারে একটা কিছু করার চেষ্টা করলাম; এ রকম একটা জায়গা থেকে আমরা ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে ধানমন্ডিতে একটা জায়গায় সামনাসামনি দেখা করি এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু ওদের ধরে নিয়ে গেছে, আমাদের ডিবি অফিসে গিয়ে ওদের খোঁজখবর নেওয়া উচিত। ওখানে থেকে ওই সিদ্ধান্তেই আমরা আধাঘণ্টার মধ্যে ডিবি অফিসে যাই। আমরা শুধু দুই থেকে তিনটি গণমাধ্যমকর্মীকে ঘটনাটি জানিয়েছিলাম। আমরা এটি সব মাধ্যমে দিইনি। আমরা বারোজন শিক্ষক ডিবি অফিসে উপস্থিত হই। সেখানেও নারী শিক্ষকদের সংখ্যা কম ছিল না এবং আমরা বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছিলাম। যেদিন আমরা ডিবি অফিসে গেলাম, সেদিন আমাদের নামে, আমার আর গীতি আপার নামে একটা জিডি করা হয়। সেই জিডিটা পাওয়ার পর আমরা ২৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে একটা সমাবেশ করি অপরাজেয় বাংলায়। সেখানেও প্রচুর মানুষ এসেছিল। ওই সমাবেশে রুশাদ ফরিদীর সঙ্গে প্রেসের কয়েকজনের ঝগড়া বেধে যায়। তৃতীয় যে সমাবেশটা, সেখান থেকে আমরা রাজু ভাস্কর্য হয়ে শহীদ মিনারে যাই এবং সেখানে ফুল দিই। সেদিন, আগস্টের ১ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল রিমেম্বারিং দ্য হিরোজ। সেদিন পর্যন্তও যে শহীদ মিনার এবং ওই এলাকায় কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না, সেই অবস্থাটাকে আমরা ভাঙতে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, নাগরিক নিয়ে রাজু ভাস্কর্য হয়ে শহীদ মিনারে যাই।
২ আগস্টে দেখি দ্রোহযাত্রা। মূল আয়োজকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ছিল। দ্রোহযাত্রা যখন ঠিক হয়, শিক্ষার্থীরাই মূলত দ্রোহযাত্রার মূল চালিকাশক্তি ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষকদের সংগঠন। আমরা এ তিনটি মোর্চা মিলে যে দ্রোহযাত্রাটি ডেকেছিলাম, আশাতীত মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। দ্রোহযাত্রা থেকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে একটা ঘোষণা দেওয়া হয়, যে ঘোষণায় আমরা শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি করি। সেটা হচ্ছে প্রথম এক দফা দাবি হিসেবে আসে। বিশাল মিছিল নিয়ে আমরা প্রেসক্লাব থেকে টিএসসি হয়ে শহীদ মিনারে পৌঁছাই। ওই দিন নেটওয়ার্কের যেসব সদস্য এসেছিলেন, তাদের সঙ্গে একত্র হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গীতিআরা নাসরিনের বাসায় বসে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি করেছি ঠিকই, কিন্তু সেটা কীভাবে হবে, এটা আমাদের ডিসাইড করতে হবে। তার পর আমরা বোধহয় পনেরো জনের মতো একটা দল বসি এবং আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই যে, একটা ছায়া সরকার প্রস্তাব করা হবে, সংবিধান সংশোধন প্রস্তাব করা হবে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে শেখ হাসিনাকে চলে যেতে হবে- এ রকম একটি প্রস্তাব করা হয়। ৩ তারিখ প্রায় সারাদিন আমরা এ প্রস্তাবটি লিখতে ব্যস্ত ছিলাম। ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে একটি প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। সেই প্রেস কনফারেন্সে আমরা রূপান্তরের রূপরেখা উপস্থাপন করি, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা দেওয়া হয়। এই রূপরেখা পরবর্তী সময় সমন্বয়কদের কাছেও পৌঁছানো হয়। পরদিন ৫ আগস্ট তো স্বৈরাচারের পতনই ঘটে। সেই সময়ও আসলে ইউটিএনের মেম্বাররা রাস্তায়ই ছিলেন। তারা কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেই ছিলেন- মধুর ক্যান্টিনে প্রেস কনফারেন্স করে জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছিলাম আমরা।