দক্ষিণপন্থি অংশ বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করছে ইলেকশনটা যেন না হয়: তাসনিম খলিল
সাক্ষাৎকার
তাসনিম খলিল ‘নেত্র নিউজ’-এর এডিটর ইন চিফ। বাংলাদেশে জনস্বার্থ সাংবাদিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর সামনে রেখে সাংবাদিকতা, রাষ্ট্র, সমাজ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক এহ্সান মাহমুদ
আমাদের সময় : গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম আলোচনা আছে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ আপনি কেমন দেখলেন?
তাসনিম খলিল : এই এক বছর বাংলাদেশ ঠিকঠাক করতেই চলে গেল। আমাদের চিন্তা-ভাবনা এখনও চলছে। আমরা সবাই জানি, আগের দিনগুলোর কথা এবং আমরা কেউই আর ওই বাংলাদেশ চাই না। আমরা চাই নতুন বাংলাদেশ। এই নিয়ে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এতে একেক জনের একেক মত ছিল। এখনও আমার মনে হয়, আগামী বাংলাদেশ কেমন হবে- এটা ঠিক করাই আমাদের এখনকার মূল আলোচনা।
আমাদের সময় : আলোচনার মধ্য দিয়ে এক বছর পার হয়ে গেল ...
তাসনিম খলিল : ৫ আগস্টের কারণে একদলীয় পুলিশি রাষ্ট্র রাতারাতি একটা দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হলো। পুলিশি রাষ্ট্র খুব একটা সবল রাষ্ট্র, তা নয়। একদলীয় পুলিশি রাষ্ট্র হঠাৎ করে ভেঙে পড়ল। রাষ্ট্রব্যবস্থার যে দুর্বলতা, সেগুলো একটা একটা করে আমাদের চোখের সামনে এলো। মূল যে সমস্যা- মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা। মানুষ নিরাপদ বোধ করছে কি না, রাষ্ট্র এখানে সফলভাবে ব্যর্থ। পরিমাপটা ওখান থেকে পাই। তো আমরা এখন যেটা দেখছি, রাষ্ট্রের অবস্থা এতই খারাপ, মানুষ এখানে নিরাপদ বোধ করছে না। আরেকটা হচ্ছে, রাষ্ট্রের মধ্যে
একমাত্র সরকারই সহিংসতা করতে পারে, যদি করতে চায়। আর কেউ করতে পারে না। যদি কেউ করে, রাষ্ট্র কঠোর হস্তে তা দমন করে। এটা যেমন এখন নাই। এই মনোবলটা প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ সরকার একেবারে ব্যর্থ।
আমাদের সময় : আওয়ামী লীগ সরকার আর এখনকার সময়ের মধ্যে পেশাগত তুলনা করতে চাই। দুটোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন কিনা ?
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
তাসনিম খলিল : হাসিনার সময় আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম (নেত্র নিউজ), সেটার অফিস খোলার সুযোগ ছিল না। আপনি নিজেও কাজ করেছেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পরিচয় প্রকাশ করা হয়, এর আগে কিন্তু গোপন ছিলেন। এটা তো একটা পার্থক্য। এটা তো নতুন বাংলাদেশ। এখন আমরা বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসন্ধান, পাবলিশ করছি। আমি নিজে যেমন বিভিন্ন জায়গায় টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছি; যতই সমালোচনা করি না কেন। ইউনূস সাহেব বা আর্মি - এদের নিয়ে যত সমালোচনাই করি না কেন, এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে একটা কথা বলেনি যে, আপনি এটা বলতে পারবেন না। এই স্বাধীনতা হাসিনার শাসনামলে ছিল না। আমি একবার মজা করে বলেছিলাম, তখনই বাংলাদেশে ফিরে যাব, যখন গদিনশীল প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকায় বসে গালাগালি করতে পারব। এখন আমার কাছে মনে হয়, সেই দিনটা এসেছে। ইউনূস সাহেবকে নিয়ে যা খুশি বলতে পারি। আমাকে কেউ তুলে নিয়ে যায় না এবং কেউ আমাকে হুমকিও দেয় না।
আমাদের সময় : বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
তাসনিম খলিল : বাংলাদেশের সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাসিনা সরকার দমন-পীড়ন যতটা না ব্যবহার করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে প্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেক পত্রিকা বাংলাদেশে হয়েছে, সেটা আসলে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট সার্ভ করার জন্য। জনগণকে সার্ভ করার জন্য না, এমনকি ওই পত্রিকা দিয়ে তারা টাকা বানাবে- তাও না। তারা স্রেফ চাচ্ছিল, তাদের যে ইন্টারেস্ট, গোষ্ঠীস্বার্থ- সেটা যেন সার্ভ করা হয়। দেখবেন, একটা পত্রিকাও মানুষ পড়তে চায় না। মানুষ টিভিও দেখতে চায় না। আমরা যেটাকে মিডিয়া বলি (ছাপা অক্ষরে পত্রিকা বা টেলিভিশন, সংবাদ চ্যানেল), এগুলোর প্রতিও বাংলাদেশের মানুষের কোনো ভরসা নেই। আমরা এখন ওই পর্যায়ে আছি। ফেসবুকের একটা গুজব বিশ্বাস করতে রাজি আছি, কিন্তু পত্রিকার খবর বিশ্বাস করি না। এটা একটা সমস্যা। কারণ, আগে থেকেই মানুষ ধরে নিচ্ছে যে, পত্রিকায় যেটা ছাপা হবে, তাতে সত্য বা অরিজিনাল রিপোর্টিংটা হবে না।
আমাদের সময় : সংবাদমাধ্যম কেন তার বিশ্বাসযোগ্য হারাল? এটা কেন হলো?
তাসনিম খলিল : দেখুন, দুনিয়ার যে কোনো জায়গার সংবাদ মাধ্যম একটি জিনিসের ওপর টিকে থাকে আর সেটা হলো- ক্রিয়েটিভিটি এবং গ্রহণযোগ্যতা। একটি সংবাদ মাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা একবার হারিয়ে ফেললে আবার সেই গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাদের দেশে সংবাদ মাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। এটার একটা উদাহরণ হলো- ক্রসফায়ারবিষয়ক রিপোর্টিং। আমরা দেখেছি, র্যাব থেকে যে প্রেস রিলিজ দেওয়া হয়েছে, সেটাই হুবহু ছাপা হয়েছে। একটা মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছে, নাকি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করা হয়েছে- এটা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম অনুসন্ধানে যায় না। বাংলাদেশের সবাই জানে, যেখানে ক্রসফায়ার হয়েছে, সেখানে প্রশাসনের লোক ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। পত্রপত্রিকায় দিনের পর দিন আনক্রিটিক্যালি এসব ছাপা হতো। আমরা আরেকটা দেখেছি- জঙ্গি নাটক সাজানো হতো। আমরা এখন জানি, তথাকথিত জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান, জিহাদি সন্ত্রাসবাদ দমনে শেখ হাসিনার একটা অভিযান ছিল। এই অপারেশন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দেখেছে জঙ্গি নাটক হিসেবে। একটার পর একটা এসব তথাকথিত জঙ্গি নাটক হয়েছে। এটা একদিনে হয়নি, ক্রমান্বয়ে করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম একদিনে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়নি। এ-ও সত্য, একদিনে ফেরতও পাবে না।
আমাদের সময় : গণতন্ত্রের অনেক রক্ষাকবচের মধ্যে সংবাদ মাধ্যম একটি। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে এবং তা আরও শক্তিশালী করে তুলতে তখন সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা কেমন ছিল?
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
তাসনিম খলিল : বাংলাদেশের গণমাধ্যমের হাসিনাশাহীকে ‘হাসিনাশাহী’ বানাতে অবশ্যই বড় ভূমিকা ছিল। যেভাবে দিনের পর দিন সরকারি ভাষ্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে; গণমাধ্যম সরকারের প্রোপাগান্ডার একটা স্টেশনে পরিণত হয়েছিল। আমরা জানি, সিঅরআই-তে বসে ঠিক করে দেওয়া হতো- কে কোথায় কোন পত্রিকায় চাকরি করবে বা কোন টিভি চ্যানেলে চাকরি পাবে। তাদের বয়ান প্রচার করেছে। বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়নের জন্য গণমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের সময় : এখন যে পরিবেশ, এটা কি বদলে গেছে?
তাসনিম খলিল : দেখুন, হাসিনাশাহীর পতন হয়েছে। হাসিনা হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেছে। এই যে শাহী ইউনিটের বাকি অংশ, যে ব্যবস্থা, যে প্রথা চালু ছিল, এতগুলো বছর ধরে কয়টার পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি তো। এখন আমাদের ভালো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এটা হয়তো পাবলিক, ব্রডকাস্টিংয়ে আমরা যেতে পারি। যেমন- একটা প্রস্তাব ছিল, বিটিভি বা রেডিও, বাংলাদেশ বেতার- এগুলোকে আমরা পাবলিক ব্রডকাস্টারে পরিণত করতে পারি। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে, শেষ হয় নাই। এখানে কোনো সম্পাদকীয় নীতি নেই। যে দুই একটি প্রতিষ্ঠানে আছে, সেখানেও ফলো করে না। যে কারণে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নামে যা হয়, এটা আসলে সাংবাদিকতা হয় না। এমনকি বড় বড় পত্রিকাগুলো যদি দেখেন, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েই গেছে। এগুলো যদি ঠিক করতে না পারি আমরা, বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যাটা ঠিক হবে না।
আমাদের সময় : আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আপনার আশাবাদ কী?
তাসনিম খলিল : আপনি তো জানেন, আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমি আশাবাদীর জায়গা থেকে বুঝেছি, শেখ হাসিনা থাকবে না। আমাদের মধ্যে একটা আশা ছিল শেখ হাসিনা। সেটা ২০১৯ সালেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা যদি আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতা ঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে সেটা শেখ হাসিনার পতনে বড় ভূমিকা রাখবে- এটা আমরা তখনই জানতাম এবং পরবর্তীতে সেটাই হলো। আবারও বলছি, আমি আশাবাদী মানুষ। আমরা ঢাকায় নেত্র নিউজের ব্যুরো অফিস করেছি। একেবারে তরুণ কয়েকজন সাংবাদিককে আমরা প্রশিক্ষণ করাচ্ছি। আমি আশা করি যে, নেত্র নিউজ ছাড়াও বাংলাদেশে জনস্বার্থ সাংবাদিকতার যে ধারা আমরা এখন প্রমোট করার চেষ্টা করছি, সেটা আগামীতে অন্যান্য পত্রিকাতাতেও প্রয়োগ করা হবে। এটা আমার আশার জায়গা।
আমাদের সময় : ৫ই আগস্টের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বারা দেশ পরিচালিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী অবস্থা থেকে এখন গণতান্ত্রিক রূপান্তর আমাদের কাক্সিক্ষত জায়গা। এই গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিয়ে আপনার কোনো সন্দেহ আছে কিনা?
আরও পড়ুন:
জোটের ভাগে অনেক নেতা নৌকা হারাবেন
তাসনিম খলিল : গণতান্ত্রিক রূপান্তর, যেটা ডেমোক্রেসি, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। আমরা ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি এবং এই রাস্তাটা একটু লম্বা। খুব সহজে আমরা একটা সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব- এমনটা বলছি না। এটা একটু প্রসেসের ব্যাপার। আমরা ওইখানে যাচ্ছি। হ্যাঁ, কিছু কিছু তো সমস্যা হবেই। যেটা এখন হচ্ছে। ভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ এখানে কাজ করছে। আপনাকে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। হাসিনাশাহীর পতনের সঙ্গে জড়িত ছিল বা গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে- এ রকম সকল শক্তিই কিন্তু গণতন্ত্রী না। এ কারণে কিছু লোক এসে বলবে ইলেকশনের কোনো দরকার নাই। তারা যখন বলে, ইলেকশনের দরকার নাই, তখন বুঝতে পারি, গণতন্ত্র চেয়ে তারা গণ-অভ্যুত্থানে অংশ গ্রহণ করে নাই। তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। এই দলগুলো বিশেষ করে দক্ষিণপন্থি যে অংশ, এরা বিভিন্ন সময় চেষ্টা করছে, ইলেকশনটা যাতে না হয়। তবে আমার মনে হয়, এরা ব্যর্থ হবে।
আমাদের সময় : জুলাই সনদকে কীভাবে দেখছেন?
তাসনিম খলিল : জুলাই সনদ বিষয়টি কী, সেটা আমরা জানি না। আপনি কিন্তু বলতে পারবেন না, জুলাই সনদ আসলে কী, কেন এটা লাগবে? ‘জুলাই সনদ’ নামে আমরা একটা গালভরা নাম শুনি। জুলাই সনদের কথা বলা হচ্ছে বেশ পরে। অভ্যুত্থানের পর জুলাই সনদ নিয়ে আলাপ ছিল না। হঠাৎ করে এখন জুলাই সনদ নিয়ে একটা আলাপ শুরু হয়েছে। জুলাই সনদ কে করবে? কারা করবে? কেন করবে- এগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আমি তো জুলাইয়ের একজন হয়ে জুলাই সনদের প্রয়োজনীয়তা দেখি না। আর দ্বিতীয় হলো, কারা দেবে সনদ? মানে জুলাই সনদ যেখানে লেখা হচ্ছে, সেখানে কি নারীদের অংশগ্রহণ আছে? প্রতিনিধিত্ব আছে? সেখানে কি প্রাইভেট স্কুলের প্রতিনিধিত্ব আছে? শ্রমজীবীশ্রেণির প্রতিনিধিত্ব আছে? আমাদের আদিবাসী ভাই-বোনদের প্রতিনিধিত্ব আছে? গুটিকয়েক রাজনৈতিক দলের এজেন্ট বাঙালি মুসলমান পুরুষের একটা সভা থেকে যদি আমি জুলাই সনদ লিখি, এটা পুরো জাতির ওপর চাপিয়ে দিতে চাই, এটা কতটুকু সমুচিত হবে- সেটা আমাদের চিন্তা করতে হবে।