দূর থেকে হাত তোলো, যদি পারো জানাও সম্মতি
অনলাইন দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত যা ছড়ায় তা হলো আক্রোশ, ক্ষোভ, ঘৃণা। আমরা আসলে পক্ষ-বিপক্ষের একটা চূড়ান্ত বাইনারি দুনিয়ায় ঢুকে গিয়েছি। চূড়ান্তভাবে হয় তুমি ভালো, না হয় চরম খারাপ; হয় তুমি আমার যুদ্ধের পক্ষে আছো অথবা সন্ত্রাসবাদের পক্ষে আছো; হয় তুমি দমনের পক্ষে আছো অথবা মার খাওয়াদের দলে আছো, হয় তুমি অশান্তির পক্ষে আছো অথবা নিষ্পেষিতদের কাতারে আছে। কোরীয় বংশোদ্ভূত দার্শনিক, সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক ও বার্লিন আর্টস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বাযুং চুল হানের মতে, ‘হ্যাঁ’ থেকে ‘না’ অনেক বেশি সশব্দ। ‘না’ বহুদূর থেকে শোনা যায়। ফলে, এই সময়ে মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক বিষয়ে দ্রুত মনোযোগ দেয়, চিৎকার ও প্রতিবাদ করে, ছোট ছোট দলে উপদলে ভাগ হয়ে তীব্র ভাষায় মতামত প্রকাশ, প্রচার করে। সাধারণত তাদের যে কোনো প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে চিন্তা থেকে আবেগের তারল্য ও উদ্বায়িতা বেশি থাকায় তা জনপরিসরে বড় কিছু করতে দেয় না। এরা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়, নিজদের অর্জন ছাড় দিয়ে ফেলে। কিন্তু এরা সুপার-স্মার্ট হিউম্যান। নিৎসে যে ওভার-হিউম্যানের কথা বলেছিলেন, তারা তার থেকেও প্রাগ্রসর, এদের বলা যায় ওভার-দ্য-ওভার-হিউম্যান। চূড়ান্ত বাবল মব; এরা সহসা তৈরি হয়, হারিয়েও যায়। স্থিতি, দৃঢ় সংকল্প, নিরবিচ্ছন্নভাবে লেগে থাকার ব্যাপারটা অনুপস্থিত। যা হওয়ার এখনই হবে, ভাববার সময় নেই। চূড়ান্ত বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে ফয়সালা করতে চায়। ফলে সময়টা প্রতিবাদের, রাজনীতির নয়। শাসকশ্রেণি এটারই সুযোগ কাজে লাগায়। কোনো একটা ধর্ষণ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠলে ধর্ষক বা দুর্নীতিবাজের গ্রেপ্তার বা সাজার ভেতর দিয়ে জনগণের প্রতিরোধ থামিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নানা আন্দোলন-গ্রেপ্তারের নাটকের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে। পরবর্তীতে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে কি হয়নি তা কেউ জানে না। সময়টা ভাইরালের। যা কিছু ভাইরাল তাতেই আমাদের সব মনোযোগ। যেমন- ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ফলাফল- শহরে একটি দুটি অন্ডারপাস বা ওভার ব্রিজ। আসেন ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলেনে। অনলাইন দুনিয়ার যে প্রবণতা তার চূড়ান্ত একটা ফলাফল ছিল এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের যে দাবি তা মূলত বাংলাদেশের অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ‘রাজাকারের বিচার’ ইস্যুকে ‘ক্ষোভ’ দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে ফেলার একটা প্রচেষ্টা। যে কথা আগেই বলেছি, ‘হ্যাঁ’ থেকে ‘না’ অনেক বেশি স্বশব্দ। ফলে বিচারের রায়ের প্রতি একটা ‘মানি না’র বিরাট আওয়াজ নিয়ে এটা দানা বাঁধতে থাকে। কাতারে কাতারে ডিজিটালিসরা অংশ নিতে থাকে শাহবাগ মোড়ে। সত্য হলো- এই বল্লার চাকের প্রাণভোমরা ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’। দেশের ফ্যাসিবাদের বীজ বপিত হয়েছে ২০১৩-এর শাহবাগের ভেতর দিয়ে এবং লক্ষ করলে দেখবেন- শাহবাগ আন্দোলনের স্টেকদের সবাই ডিজিটাল লিটারেট। ২০১৩-তে শাহবাগে তাদের একত্রিত হতে প্রায় এক দশকের অপ্রাতিষ্ঠানিক অন্তর্জালের শিক্ষা নিতে হয়েছে, তারা একটা বিশেষ প্রবণতাসম্পন্ন ওভার-দ্য-ওভার হিউম্যান। এই ওভার-দ্য-ওভার হিউম্যানরা কোনো গভীর, দীর্ঘমেয়াদি ক্রিটিক্যাল চিন্তা করতে পারে না। লাইট অ্যাকশন ক্যামেরার সময় এটা। নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের কোনো প্রতিনিধি শাহবাগে পাবেন না। তার পরও ‘গণজাগরণ’ মঞ্চ? এই গণটা কারা? হোমো ডিজিটালিসরা, ওভার-দ্য-ওভার হিউম্যান। আর গরিরের প্রতিনিধি পাবেন কোথায়? শাপলায়। শাপলায় তাদেরকে স্রেফ এতট মানববর্ম হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম ও তাদের নেতারা। এই ইসলামপন্থি দলগুলো পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট সরকারের নানা দাওয়াতে নানা কায়দায় অংশগ্রহণ করেছে। এরাই ভারতের নির্বাচনের আগে মোদির বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় যে নৈরাজ্যকর অবস্থা বাংলাদেশে দেখিয়েছে তা দিল্লিতে মোদির ক্ষমতা ফিরে পেতে সাহায্য করেছে। এই মোদির দিল্লি বাংলাদেশের বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনের সবচেয়ে বড় দোসর ছিল।
শাহবাগ বা শাপলার শিক্ষার ভেতর দিয়ে একটা বিপুল রাজনৈতিক সচেতন প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে, যা বিপুল বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান তৈরি করেছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় রক্ত ঢেলে জুলাইয়ের দিনগুলো আমরা ৩৬ পর্যন্ত উন্নীত করতে পেরেছিলাম। দুনিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশিরাই পেরেছে সময়, শাসন ও শোষণকে এক সঙ্গে উল্টে দিতে। পতিত ফ্যাসিস্ট পলাতক। প্রতিবেশী দেশে যেভাবে সে আছে সেটা কোনো সম্মানজনক রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, প্রকারান্তরে কারাবাস। এই অসম্ভব সাধান যারা করেছে তারা বেশির ভাগই তরুণ একটা প্রজন্ম, যারা একদা নিষ্পেষিত, শোষিত, অধিকারহারা, দুর্বল ছিল। বিপুল একটা তরুণ প্রজন্মসহ আওয়ামীবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে বিগত দেড় দশক যতটা পারা যায় নানাভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের ভেতর দিয়ে নানা ফর্মে দুর্বল আজ সবল হয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পেয়েছে। দুর্বল মানেই যে সে জনদুশমন হয়ে উঠতে পারে না, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। সাধারণত মানুষ দুর্বলের প্রতি সহমর্মী হয়ে থাকে- এটাই মানুষের প্রবণতা। কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না, দুর্বলকে এমনভাবে বড় করে তুলতে হয়, যেন সে দুর্বৃত্ত না হয়ে ওঠে, সবলকে এমন ভাবে ছোট রাখতে হয়, যাতে সে শয়তান না হয়ে ওঠে- ঐতিহাসিকভাবে এটাই ৩৬ জুলাইয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা সকলের জন্য। জুলাইয়ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো- রাজনীতি সচেতন তরুণ-সমাজ। ফলে আগামীর বাংলাদেশে যারা সক্রিয় রাজনীতি করবেন তারা যেন ভুলে না যান পূর্বের দুর্নীতি, অবিচার, দুঃশাসন, দমন-পীড়নের যে অপরাজনীতি এখানে তা খুব বেশি কার্যকর হবে না।
২০২৪-এ যে রাজনীতি-সচেতন প্রজন্মের জন্ম হয়েছে তারা যেন স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখে। ডিজিটাল দুনিয়ার যে অবর্জনার ঝড় তা যেন তাদের মনন ও রাজনৈতিক শিক্ষাকে বিচলিত না করে ফেলে। ফলে যে-ই নেবে দানবের ভূমিকা তাকে ভূপাতিত করার বাসনা যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বিক্রি করে না দেয়। স্বাধীন ইচ্ছা মানে- আমি কী করব না সেই সিদ্ধান্ত, মন যা চায় তা করা নয়। দুর্বলকে এমনভাবে বড় করে তুলতে হয়, যেন সে দুর্বৃত্ত না হয়ে ওঠে, সবলকে এমনভাবে ছোট রাখতে হয়, যাতে সে শয়তান না হয়ে ওঠে।