ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রশ্ন

রেজাউর রহমান লেনিন
০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রশ্ন

বিগত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনকালে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমবর্ধমানভাবে বিতর্কের শীর্ষে এসেছে। বিগত সরকারের তথাকথিত ‘আনুষ্ঠানিক উন্নয়নদর্শন’ ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারকে হয়তো নাগরিকদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করেছিল, তবু ভিন্নমতকে দমন এবং অনলাইন আখ্যান নিয়ন্ত্রণ, জেন্ডারিং নজরদারি, যৌন হয়রানি ও নানা ধরনের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনকালে সেন্সরশিপ, নজরদারি এবং দমনমূলক আইনের ব্যবহার ছিল ‘বিস্তৃত’, ‘ব্যাপক’, এবং ‘নিয়মতান্ত্রিক’। গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের ব্যবহার খরচ, গুণমান এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন ব্লগার, কার্টুনিস্ট, শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিক এবং মানবাধিকারকর্মীসহ নানা পেশায় সংযুক্ত নাগরিকবৃন্দ এবং যে সমস্ত নিপীড়নমূলক আইনসমূহ- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, টেলিযোগাযোগ আইনসহ এ-সংক্রান্ত নীতিমালাসমূহ প্রয়োগ করা হয়েছে তা প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা ছিল শূন্য থেকে মহাশূন্যময়। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে কেন্দ্র করে ঐ এলাকায় থ্রি জি, ফোর জি ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

হাসিনার আমলে নাগরিক সুরক্ষা এবং অধিকারের দিক থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সংক্রান্ত আইনসমূহ প্রণয়নের কিছু বাস্তবতা রয়েছে বলে দাবি করা হলেও, এ আইনসমূহের অনেকগুলো বিধান রাখা হয়েছিল, যেগুলো নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ও নানাবিধ মৌলিক নাগরিক অধিকারকে সীমিত করছে এবং নাগরিকদের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডকে অপরাধীকরণ করেছে। মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং ত্রুটিগুলো আইনি অজুহাতগুলো ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বা ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর মতো অস্পষ্ট ভাষায় ভরা ছিল, যার ব্যাখ্যা মূলত শেখ হাসিনার সরকারের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে সরকারি সংস্থাগুলো প্রকৃত জবাবদিহিতা ছাড়াই মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চালিয়ে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমানে উল্লেখযোগ্য হাই-প্রোফাইল মামলাসমূহের অভিযোগের বিষয়বস্তুসমূহ নির্দেশ করে বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার এবং এ-সংক্রান্ত আইনসমূহ ব্যবহার করে দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করতে সাহায্য করেছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে।

ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে, বাংলাদেশ একাধিক ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের স্থান ছিল যা রূপ, তীব্রতা এবং ভৌগোলিক প্রসারের দিক থেকে বৈচিত্র্যময় ছিল। আন্দোলনের ব্যাপকতার এবং ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের সময়কাল ধরে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই ২২ দিনের মাঝে ২০ দিনই ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত- শুধু ১ এবং ৩ আগস্ট ২০২৪ ছাড়া, যা রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সময়কাল উভয় ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন। প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষ যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল, যার মধ্যে সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট থেকে শুরু করে ‘ব্যান্ডউইথ থ্রোটলিং’ এবং ‘সিলেক্টিভ ব্লকিং’ পর্যন্ত সবকিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অতীতে ঘটে যাওয়া অন্য যে কোনো ঘটনার তুলনায় বিস্তৃত এবং ব্যাপক। জাতিসংঘের প্রতিবেদনসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা এই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ নথিভুক্ত করা হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যাসহ সহিংসতায় সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালের আগস্টে জানা যায় যে নিহতদের ৭৮% প্রাণঘাতী গুলির আঘাতে মারা গেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত গণহত্যায় ১৪০০ জনের বেশি নিহত হন এবং আহতের সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি। বন্ধের মাত্রা বা জটিলতা, নিয়ন্ত্রণের একাধিক স্তর বাস্তবায়নের মধ্যে দেশব্যাপী ব্ল্যাকআউট এবং ব্যান্ডউইথ থ্রোটলিং, পাশাপাশি ক্যাশে সার্ভারগুলো নিষ্ক্রিয় করা এবং সামাজিক মাধ্যম এবং ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কগুলো (ভিপিএন) লক্ষ্যবস্তু ব্লক করা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সময়কালে, বাংলাদেশের বিগত সরকার যৌক্তিকতা বা যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই অঘোষিত ইন্টারনেট বন্ধ কার্যকর করেছিল, যা যুক্তিযুক্তভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছিল এবং অভ্যন্তরীণ সাংবিধানিক সীমা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে সরকারের বলপ্রয়োগ ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্তের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ- জোরপূর্বক গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, বেশির ভাগ ইন্টারনেট বন্ধের সময়। সামাজিক মাধ্যমে প্রবেশাধিকারের অভাব এবং গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্যকে বাধা দিয়েছে, যার প্রাপ্যতা ইন্টারনেটের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিল। পরিহাসের বিষয় হলো, অধিকার হরণকারীদের মধ্যে যেমন রয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তেমনি রয়েছে রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে থাকা ব্যক্তিবর্গ। গণসংহতি এবং শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের ক্রান্তিকালের, ইন্টারনেট সংযোগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রায়শই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে বাধ্য, আগামীর বাংলাদেশ গঠনের, কেমন করে বর্তমান বাস্তবতা এবং আইনি কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া হয়তো আর কোনো ভূমিকা নেই। া