আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নেমে যাচ্ছে পারদের মতো
সময়টা ছিল ধনুকের ছিলার মতো টান টান, মুহূর্তগুলো ছিল ডিমের খোসার মতো ভঙ্গুর, যেন একটা জুতসই টোকা লাগার অপেক্ষামাত্র, তার পরই সবকিছু ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঝরে পড়বে। জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ জমে জমে বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ছিল। শুধু সঠিক সময়ে একটা স্ফুলিঙ্গের প্রতীক্ষা। মানুষ জানত না কীভাবে কী হবে, কিন্তু কিছু একটা যে হবে, সে বিষয়ে অনেকেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। ২০২৩ থেকেই পুরনো মানুষরা ফিসফিস করে বলাবলি করছিলেন, তারা পঁচাত্তরের মতো ভিন্ন নামে বাকশাল কায়েমের আলামত দেখতে পাচ্ছেন। এরই মধ্যে ২০২৪-এর জানুয়ারিতে আবার একটা একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘ক্ষমতায় অব্যাহত থাকার কৌশল বাস্তবায়নের একতরফা নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আইনগত বৈধতা নিয়ে হয়তো কোনো চ্যালেঞ্জ হবে না। তবে এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদণ্ডে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।’
এসব মন্তব্য কেয়ার না করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করল তা হলো- জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক সরকার। মন্ত্রী, এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ দল-ভৃত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। বিরুদ্ধ মত বলে কোনো কিছুই রইল না। বরং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার ও দমন-পীড়ন চালানো হলো। অনেকেই ভয়ে চুপ করে গেলেন। জবাবদিহি না থাকায় চারদিকে চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের মহোৎসব শুরু হলো। চাটুকার পরিবেষ্টিত প্রধানমন্ত্রী নিজের বৃত্তেই আত্মতৃপ্তিতে আটকে রইলেন।
যে বয়ানটা তখন চালু ছিল, তা হচ্ছে- বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে একমাত্র আওয়ামী লীগই প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ধারণ করে। ফলে দেশের উন্নয়ন চাইলে একমাত্র তাকেই সমর্থন করতে হবে। অনেক মানুষকেই তখন বলতে শুনেছি, ‘আওয়ামী লীগ যা করছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না! কিন্তু ওদের বাইরে আর কাকেই বা সমর্থন করব? বিএনপির নেতৃত্ব দুর্বল। জামায়াতকে তো বিশ্বাসই করা যায় না।’
ছয় মাস এভাবেই কেটে গেল। জুনে আবার সামনে এলো বহুল আলোচিত কোটা পদ্ধতির সংস্কার প্রসঙ্গ। প্রলম্বিত জুলাই পর্যন্ত গড়াল ছাত্রদের এই আন্দোলন। বরাবরের মতোই সরকারি তরফ থেকে প্রথম দিকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছিল না এই আন্দোলনকে। এর পরের কাহিনি তো সবারই জানা। ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসতে থাকা জনস্রোতকে বাধা দেওয়ার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল তখনকার সরকার। গুলি করে, লাশ ফেলে, ভয় দেখিয়ে, গ্রেপ্তার করে, রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েও কোনোভাবেই আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারল না আওয়ামী লীগ। ফ্যাসিবাদের এক ভয়ানক নির্মম করুণ পতন বা পলায়ন দেখল জনগণ। বিশ^বাসী দেখল জনতার এক অভূতপূর্ব বিজয়। মোটাদাগে জুলাইয়ের যে চেতনা সেটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। জুলাই আন্দোলনে নারীদের গৌরবময় অংশগ্রহণ ছিল। গত এক বছরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নারীবিদ্বেষী, নারীবিরোধী একটি সংস্কৃতি যেন সর্বত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, যা খুবই ক্ষতিকর। জুলাই আন্দোলনে নেতাদের মুখে বারবার একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ নির্মাণের কথা শোনা গিয়েছিল, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র নির্বিশেষে সবই সমভাবে সমান অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু সেগুলো যে দিন দিন শুধু কথার কথা হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, তা কি কেউ কখনও ভেবেছিল?
আরও পড়ুন:
‘বৈষম্যহীন’ সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা
শিক্ষা নিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট এখনও চলছে। দেশের বিরাটসংখ্যক ছাত্রছাত্রী দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা মাদ্রাসায় পড়ছে। তাদের কারিকুলাম কীভাবে আরও জীবনমুখী ও আধুনিক করা যায়, তা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনাই চোখে পড়ে না। ইংলিশ মিডিয়াম ছুটছে বিদেশে, বাংলা মিডিয়াম বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত আর মাদ্রাসা মিডিয়াম পরকাল আর ইহকালের দ্বন্দ্ব ঘুচাতে বিভ্রান্তির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদে তাদের অনেকেই কখনও নারীর প্রতি কুৎসা রটনা করছে, আবার কখনও মাজার ভাঙতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী, যা সব অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের পরই থাকে। বৈষম্য দূর হওয়ার যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও মানুষ সংশয়ে ভুগছে।
সবচেয়ে বড় যে বৈষম্য ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান, তা কমানোর জন্য কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? দেশে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা যারা সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় কোটা পদ্ধতির বিলোপ চেয়েছিলেন, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কি করা গেছে? আরও যারা নিরক্ষর বা কম শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ঘুরছেন কাজের আশায়, তাদের ব্যাপারেও তো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অনেক সময় মনে হয়, এ দেশে সব বাদ দিয়ে জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এখনও গ্রামে-গঞ্জে মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ছে। সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। এমনকি প্রাণও হারাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নেমে যাচ্ছে পারদের মতো
জানি রাতারাতি আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক সরকার যা করতে পারবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে হয়তো তা করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে দ্রুত জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার বা দায়িত্বের হস্তান্তর জরুরি। সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আরও আলোচনা চলুক। নীতিগত পরিবর্তন দরকারি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সব দলিল-দস্তাবেজ তৈরি করতে বেশিদিন সময়ক্ষেপণ হলে তার প্রতিক্রিয়া খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। সব পক্ষেরই এ ব্যাপারে নমনীয় হয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। এই জনতা এখন নীরব থাকলেও খুব বেশিদিন যে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখা সম্ভব হবে না তা নিশ্চিত। া