যত লোক শহীদ হয়েছে, দোষী সবার বিচার চাই
ছাত্র হিসেবে আবু সাঈদ ছিল মেধাবী। এসএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পায়। রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। আমাদের আর্থিক অবস্থা ততটা ভালো ছিল না। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। কলেজে ভর্তির টাকা দিয়েছি গরু বিক্রি করে। একবার পরীক্ষার সময় একটা জমি ৩০ হাজার টাকায় বন্ধকও রাখি। পরে ঢাকায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে গোপালগঞ্জে পরীক্ষা দেয়। ভর্তি পরীক্ষায় সে টিকেছিল। ১৬ সিরিয়ালে ছিল। কিন্তু অভাবের কারণে ওখানকার বিশ^বিদ্যালয়ে আর ভর্তি হতে পারে নাই। রংপুরে এসে রোকেয়া ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিয়ে টেকে। অনার্স পাস করে নিবন্ধন পরীক্ষা দেয়। টিকছিলও।
আবু সাঈদ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, আমরা জানতাম না। জানতাম, কোটা আন্দোলনে সে যাবে না। পরে চেম্বারের ভেতরে বক্তব্য দিল- আমরা যে আন্দোলন করছি, এটা সরকারবিরোধী না। তাতে ছাত্রলীগ এসে গলা চিপে ধরে, গালে-মুখে থাপড়ায়। সেই কারণে রাস্তাত নেমে পড়ে, না কী হলো জানি না। ও যে আন্দোলন করছে, বাড়িতে কোনো সংবাদ দেয় নাই। বন্ধু-বান্ধব ছিল, ওদেরকেও নিষেধ করেছিল, যেন বাড়িতে কোনো খবর না দেওয়া হয়।
১৬ জুলাই ২০২৪, ১১টা। আবু সাঈদ মিছিলে গেল। সকালের ভাতও খায় নাই। যা নাস্তা-পানি করছে, তা-ই। তার পরে শুনি দেড়টার সময় মারা গেছে। ও যখন মাটিতে পড়ে গেছে, তখন ছাত্ররা তুলে মেডিক্যালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা মৃত্যু ঘোষণা করে। ওখান থেকে লাশ আনার সময় রাস্তায় পুলিশ ধরে, লাশ কেড়ে নিয়ে যায়। এ সংবাদ বাড়িতে এলো বিকাল ৩টার দিকে। তখন দুই মেয়ে জামাই, দুই ছেলে সিএনজি ভাড়া করে নিয়ে মেডিক্যালে যায়। কিন্তু লাশের কোনো খবর পায় নাই। ভার্সিটির ভিসি, ছাত্র, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে খোঁজ করে। লাশ দেখায় না কেউ। পরে ছেলেরা বলছে- আমার ভাই মারা গেছে, লাশটাও দেখতে পাব না? পরে দেখতে দেয়। তখন ছেলেরা বলেছে- আমার লাশ দাও। আমরা কোনো মামলা করব না। আমরা নিয়ে গিয়ে দাফন করব। তার পরে রাত ২টার সময় লাশ দিয়েছে। ১৮টা পুলিশের গাড়িসহ রাত সাড়ে ৩টার সময় লাশ নিয়ে আসে। তার পর ইউএনও পুলিশসহ যত প্রশাসন, সবাই এসে বলে- রাতেই মাটি দাও। আমি বলেছি- না, এটা সম্ভব না। কোন জায়গায় কবর দেব চিন্তা করা লাগবে, আমার আত্মীয়-স্বজন লাশটাকে দেখবে। তখন বলে- সকাল ৬টায় মাটি দিও। আমি বলেছি- ৮টার সময় মানুষ ঘুম থেকে ওঠে, সেখানে ৬টার সময় মাটি দেব কীভাবে? পরে বলে ৮টার সময়ে দিন তাহলে। পরের দিন কবর খোঁড়া শুরু হলো। মসজিদের সামনে জানাজায় লোকের জায়গা হয় নাই। প্রশাসন বলে- একবার না-হলে কয়েক দফায় এখানেই জানাজা করো। কিন্তু আলেম-ওলামা রাজি হয় নাই। পরে কামিল মাদ্রাসার মাঠে নিয়ে যায়। ওখানে এসে দেখি, ১০ হাত দূরে থেকে মানুষের ভিড়। আমি আর যেতে পারি নাই। কে লাশ নামাল, কী করল- আমি দেখতে পারি নাই। এই মাটি দিয়ে রেখে ওই শয়তানরা চলে যায়। আজ পর্যন্ত আর কারও চেহারা দেখি নাই। যখন হাসিনার পালানোর সংবাদ এলো, তখন মানুষের ঢল পড়ে গেল। মানুষ আর মানুষ, বাড়িতে জায়গা দেওয়ার উপায় ছিল না। তার পরে ডা. শফিকুল সাহেব এলেন, ড. ইউনূস এলেন, মির্জা ফখরুল এলেন। বহু লোক এলেন।
আবু সাঈদ অনেক বড় হতে চেয়েছিল। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। আবু সাঈদ বিসিএস ক্যাডার হতে চেয়েছিল। সন্তানের স্মৃতি আজও কাতর করে খুব। রোকেয়া ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে সাঈদের কম যোগাযোগ ছিল। মোবাইল নাই। আমার সঙ্গে ওর সর্বশেষ কথা হয় গত বছর কোরবানির ঈদের ছুটিতে ও যখন বাড়ি আসে। পরে চলে যায়। আমার সঙ্গে আর কথা হয় নাই।
আরও পড়ুন:
আরও ১০৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ
সন্তানের মৃত্যুসংবাদ কেমন, তা কেবল ভুক্তভোগী মা-বাবাই জানেন। সাঈদের মৃত্যুর দিন আমি মাঠে কাজ করছিলাম। এমন সময় খবর আসে- আবু সাঈদের কী যেন হয়েছে। বাড়ি ফিরে এসে দেখি পাশের বাড়ির ভাতিজাবউ কাঁদছে। কেউ আমাতে কিছু বলে না। পরে শুনলাম গুলি লাগছে। ভাবছিলাম, গুলি লাগলেও বেঁচে থাকতে পারে। অনেকক্ষণ পরে শুনি ও মারা গেছে। আমি কাঠের ওপর বসেছিলাম। কখন মাটিতে বসে পড়েছি- জানি না।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আবু সাঈদ শহীদ হলো। কিন্তু ঘুষ ছাড়া তো চাকরি নাই। বৈষম্য দূর হলো কেমনে? এই সরকার যদি না-ও পারে, পরের বারের গণতান্ত্রিক কোনো সরকার নিশ্চয় সংস্কার করবে, বৈষম্য দূর করবে। আবু সাঈদের আত্মত্যাগও মূল্যায়ন করবে আশা করি। দেশ ও দেশের মানুষ যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং মুখে কথা বলার অধিকার পায়।
আমি এখন ছেলেহারা। আমি অনেক সাংবাদিকের কাছে বলেছি- আমার যা গেছে গেছে। আমার বা অন্য মায়ের কোল যেন আর জীবনেও খালি না হয়। দেশে যেন একটা সরকার গঠন হয়। দেশ ও দেশের মানুষ যেন শান্তিত থাকতে পারে।
আবু সাঈদ হত্যার বিচার দ্রুত দেখতে চাই। নির্বাচনের আগেই বিচারের প্রক্রিয়া দেখতে চাই। বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই। আমার ছেলের সঙ্গে আরও যত লোক শহীদ হয়েছে, দোষী সবার বিচার দেখতে চাই। া
অনুলিখন : খন্দকার রাকিবুল ইসলাম