সংবিধান সংস্কার, ঐকমত্য কমিশন গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র: ফরহাদ মজহার

সাক্ষাৎকার

এহ্‌সান মাহমুদ
০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সংবিধান সংস্কার, ঐকমত্য কমিশন গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র: ফরহাদ মজহার

ফরহাদ মজহার। কবি, ভাবুক ও মানবাধিকারকর্মী। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে কয়েক দশক ধরে চর্চা করছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি এবং দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- এহ্‌সান মাহমুদ

আমাদের সময় : গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই সময়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ফরহাদ মজহার : প্রথমত, গণ-অভ্যুত্থান একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এর প্রথম তিন দিনকে আমি গাঠনিক মুহূর্ত ও গাঠনিক পর্ব বলি। ৫ থেকে ৮ আগস্ট- এটিই আসলে গণ-অভ্যুত্থান পর্ব। এরপর ৮ আগস্টে শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন আসলে ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’। অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানকে আবার সংবিধানের নামে দমন করা হয়েছে। উপদেষ্টা সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আসলে গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নস্যাতের পর্ব শুরু হয়েছে। এরপর আমরা যেসব বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি, এ সবই হচ্ছে প্রথম ভুল বা আদি পাপের ফসল। দ্বিতীয় বিষয় হলো, ড. ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র দিলেন না। জুলাই ঘোষণাপত্র মূলত জনগণের অভিপ্রায়টা ব্যক্ত করা, যা নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তি, যা বাস্তবায়নের জন্য আমরা নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতাম। এই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করলে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় প্রকাশ পেত। আমাদের পরবর্তী পথচলার দিকনির্দেশনা পেতাম। কিন্তু তাকেও তো নস্যাৎ করা হয়েছে।

আমাদের সময় : সরকার তো বলছে তারা এই ঘোষণাপত্র দিতে চায়।

ফরহাদ মজহার : এটা করার অধিকার উপদেষ্টা সরকারের নেই, কারণ তারা শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষায় শপথ নিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো, ড. ইউনূস গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক নন, ফলমাত্র। রাজনৈতিক দলগুলো এককভাবে এই অভ্যুত্থান ঘটায়নি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ‘ঐকমত্য’ করে তো জনগণ গণ-অভ্যুত্থান করেনি। জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার তারা তো কেউ না। আর জনগণ তো কোনো জুলাই সনদ চায়নি। এই ধারণা গণ-অভ্যুত্থানবিরোধীদের আবিষ্কার। ড. ইউনূস শুরুতে জুলাই ঘোষণাপত্র না দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি তার মন্ত্রণালয়ে এমন কিছু লোককে বসিয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ক্রমাগত অভিযোগ আসছে। তিনি যথাযোগ্য ও সৎ লোক দিয়ে তার মন্ত্রণালয় সাজাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সেনাবাহিনী খুব বড় একটি ঝুঁকি নিয়েছে। পুলিশের যে দায়িত্ব, যে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার, সেটি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। সেটা তো সেনাবাহিনীর কাজ নয়। তাদের কাজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত থাকা। এতে করে সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো, যার দৃষ্টান্ত গোপালগঞ্জ। ওখানে আওয়ামী দুর্বৃত্তরা তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে হামলা করেছে। এটি পরিষ্কার। কিন্তু তাদের প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীকে গুলি চালাতে হলো। এর দায় কে নেবে? দায় তো সেনাবাহিনীর ওপর বর্তাবে। সেনাবাহিনীকে এই দায়িত্ব না দিয়ে পুলিশকে রিফর্ম করা যেত। তা হলো না। এতদিন গেল, পুলিশ বাহিনী ঠিক করা বা নতুন পুলিশ নিয়োগ হলো না কেন? ফলে আমরা একটি দুর্বল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেলাম। এমনই দুর্বল যে, তার অধীনে আরেকটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেটি হলো কৃষি। আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে কৃষি রিলেটেড কিছু শোনা যায় না। এটি কেমন ব্যবস্থা? কৃষি মন্ত্রণালয় হলো আমাদের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে আরেকটি মন্ত্রণালয় সামলাতে হচ্ছে। এখানে দৃশ্যত তার ভূমিকা চোখে পড়ছে না।

আরেকটি বিপদের বিষয় হলো, গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা যতটা সরকার নিয়ে আলাপ করছি, ততটা কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ে নয়। আমরা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নির্বাচন তো একটি সরকার দেবে। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন করবে কে? একটি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় জনগণের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে। সেই লক্ষ্য থেকে আমাদের দৃষ্টি ক্রমাগত সরে যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে নামিয়ে আনা হচ্ছে পুরনো ব্যবস্থা বহাল রেখে স্রেফ সরকার পতনের আন্দোলন হিসেবে। এতে করে গণ-অভ্যুত্থানের মর্ম এবং জনগণের সামষ্টিক আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের পথ থেকে আমরা দূরে চলে যাচ্ছি। সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার করবে, জুলাই সনদ তৈরি করবে। এখানে মারাত্মক ভুল হচ্ছে, অভ্যুত্থানের একমাত্র শক্তি গুটিকয়েক রাজনৈতিক দল ছিল না। বরং লুটেরা-মাফিয়া রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধেই এই অভ্যুত্থান ঘটেছে। এতে করে অভ্যুত্থানের পক্ষের গণমানুষকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

আমাদের সময় : এ ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন, সম্প্রতি অনেক নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররাও আলাদা পার্টি গঠন করেছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা কতখানি?

ফরহাদ মজহার : ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন প্রথমত এর দায় পড়বে এনসিপি বা গণ-অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে বলা হয়ে থাকে, সেসব ছাত্রনেতার ওপর। কারণ বাংলাদেশের জনগণ এই ছাত্রদের ওপর ভরসা করেছিল যে, তারা গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করবে এবং জনগণের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গড়বে। কিন্তু তারা বানাল নির্বাচনবাদী দল। লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণি গণতন্ত্র বলতে জনগণের ক্ষমতা বোঝে না। লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা যেভাবে দল চালায়; বড়লোকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া, তাদের অর্থায়নে নির্বাচনে অংশ নেওয়া- এনসিপি নিজেকে সেই প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিল। এটা মারাত্মক ভুল।

কিন্তু তাদের প্রতি জনগণের এখনও আগ্রহ আছে। এখনও তারা মানুষের কাছে গিয়ে বিপুল সাড়া পাচ্ছে, আমার আশা, তারা জনগণের অভিপ্রায় ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করে নির্বাচনে অংশ নিলে জনগণের সমর্থন পাবে না। তাদের আদর্শ ও লক্ষ্যকে পরিচিত করানোর জন্য নির্বাচনের ছুতায় রাজনৈতিক প্রচারণায় তারা যেতেই পারে। সেটা হবে ‘কৌশল’। কিন্তু তাদের রাজনীতিটা কী, সেটা পরিষ্কার নয়। রাজনীতির এই অভাব তাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।

তবে নাহিদ (নাহিদ ইসলাম) বিভিন্ন সমাবেশে নতুন সংবিধানের কথাটি জোরালোভাবে বলছে। জুলাই ঘোষণাপত্র এখনও হয়নি। এই ঘোষণাপত্র গণসার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণাপত্র, যে বাংলাদেশ তিনটি নীতির (মানুষের অধিকার ও সামাজিক সম্মান, গণমানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা) আলোকে চলবে। এটা হলো প্রথম কথা। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনাসহ গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও দেশের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা- এটা হচ্ছে জুলাই সনদের মূল বিষয়। এই জুলাই সনদকে যদি এনসিপি পুরোপুরি ধারণ করতে পারে, তাহলে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের সমর্থন তারা পাবে।

আমাদের সময় : তাহলে আপনার কথায় ‘ব্যর্থ গণ-অভ্যুত্থান’...

ফরহাদ মজহার : না, না, এটাকে ব্যর্থ গণ-অভ্যুত্থান বলছি না। দেখুন, শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তার সরকারের পতন হয়েছে। এ অভ্যুত্থান সেদিক দিয়ে সফল। কিন্তু অভ্যুত্থানে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকার পতনই মানুষের একমাত্র প্রত্যাশা ছিল না। তারা একটি নতুন বাংলাদেশ চেয়েছে।

আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই অভ্যুত্থান ঘিরে মানুষের যে সামগ্রিক প্রত্যাশা, তা পূরণ হয়নি। আমরা সুযোগকে কাজে লাগাতে পারিনি। কারণ সরকার ও রাষ্ট্রের পার্থক্য আমরা বুঝি না। গাঠনিক মুহূর্তকেও আমরা তাই আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারিনি। গাঠনিক মুহূর্ত বলতে ৫ তারিখে ক্ষমতা জনগণের হাতে এলো, তখন আমরা ঘোষণা দিতে পারিনি- ‘আমরা এই ঘোষণা দিচ্ছি যে, আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করিলাম। এরপর আমাদের ফরমান ও আদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে।’ এ কথা বলার যে হিম্মত, সেই হিম্মত কেউ এখনও অর্জন করেনি। ফলে এখন এনসিপির তরুণদের গণমানুষের রাজনীতিচর্চার মধ্য দিয়ে তাদের সেই হিম্মতটা অর্জন করতে হবে। এই হিম্মত অর্জনের জন্য শিক্ষা ও জ্ঞান জরুরি। তত্ত্ব এবং তৎপরতা ঠিক রেখে বক্তব্য দেওয়ার প্রজ্ঞা অর্জন করতে হবে। তত্ত্বের সঙ্গে চর্চার মিল চাই, চর্চার সঙ্গে তত্ত্বেরও মিল চাই।

আমাদের সময় : এই তাত্ত্বিক আলোচনার বাইরে গিয়ে আমরা যদি পলিটিক্যাল বাস্তবতার দিকে তাকাই, রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরার প্রচেষ্টা আছে। তারা চাইছে দেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে। একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় রূপান্তর করবেন।

ফরহাদ মজহার : নির্বাচনটা কিসের, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। যদি শেখ হাসিনার লুটেরা ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র অক্ষুণ্ন রেখে সরকার নির্বাচন হয়, তবে সেটা হবে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির ক্ষমতারোহণের নির্বাচন। শহীদ ও পঙ্গুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। যদি গণপরিষদ নির্বাচন ও নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের নির্বাচন হয়, তাহলে তার জন্য আমাদের আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। গণতন্ত্র বলতে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করা বোঝায়। অর্থাৎ সবার আগে জনগণের কাছে ক্ষমতা নিশ্চিত করে- এমন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে।

আমাদের সময় : এটার প্রক্রিয়াটা কেমন বলে মনে করেন?

ফরহাদ মজহার : প্রথমত, গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন গণতন্ত্রচর্চার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। গণতন্ত্র মানে হলো, একটি রাষ্ট্রের ধরন। এই ধরনের মধ্যে জনগণ, সার্বভৌম- এ নীতিটা কায়েম হয় এবং জনগণ গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করতে পারে- এমন একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা। গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম কাজ ছিল একটি গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা। নতুন বাংলাদেশ পরিচালনার জন্য যে বিধান দরকার, সেটা প্রণয়ন করা ছিল প্রথম কাজ। এই কাজটি উপদেষ্টা সরকার করেনি। না করেই আপনি নির্বাচন চাচ্ছেন। কিসের নির্বাচন? সরকার নির্বাচন। সরকার নির্বাচন মানেই হলো লুটেরা-মাফিয়াদের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করে দেওয়া। ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেভাবে এগোচ্ছেন, এতে করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেই লুটেরারাই নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসবে। তাহলে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে কীভাবে? তিনি সরকার বদল চাচ্ছেন। আমরা তো আগের সরকারের বদলে তারই মতো আরেকটি লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির সরকার চাচ্ছি না। আপনি বলছেন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা। এভাবে গণতন্ত্র কি কায়েম হবে? আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে গণতন্ত্র কীভাবে চর্চিত হচ্ছে? মানুষের ন্যায়বিচার, নাগরিক মর্যাদা-অধিকার- এগুলো আমাদের দেশে আছে? আমরা তো ফরাসি বিপ্লবের মতো সাম্য-মর্যাদার ঘোষণা দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের অবস্থান ঠিক এর বিপরীতে। আমরা আবার লুটেরা-মাফিয়াদের শাসন কায়েম করতে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সরকার জাতীয় ঐক্য নিয়ে তৎপর। কিসের জাতীয় ঐক্য? আমাদের তো গণঐক্য ছিল বলেই সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছি। এখন নতুন করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া মানে গণঐক্যকে নষ্ট করা। জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পুরনো গণদুশমনদের নতুন মোড়কে হাজির করা

আমাদের সময় : তাহলে জাতীয় ঐক্যের প্রয়াস কি কেবল সময়ক্ষেপণ?

ফরহাদ মজহার : এটা আসলে প্রচলিত সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া।

আমাদের সময় : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভবিষ্যৎ আপনি কী দেখছেন?

ফরহাদ মজহার : জিরো। এটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। গ্রহণযোগ্যতাও নেই। এটি জনগণ গ্রহণ করবে না। কেন করবে? শেখ হাসিনাও কিছু রাজনৈতিক দল নিয়ে নির্বাচন দিয়েই টিকে থাকতে চেয়েছিল। জনগণ মেনে নিয়েছে? সংবিধান সংস্কার, ঐকমত্য কমিশন- এ সবই মূলত গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র। এটি প্রতিবিপ্লবের পথকে উন্মুক্ত করছে। সুতরাং ইউনূস সরকারও খুব বেশিদিন টিকতে পারবে না। কারণ তারা জনগণের পক্ষে কাজ করছে না।

আমাদের সময় : তবে এই সরকারের পর আমরা কার আসার সম্ভাবনা দেখছি?

ফরহাদ মজহার : আমি জানি না। তবে প্রেডিক্ট করতে পারি।

আমাদের সময় : আপনার প্রেডিকশনে কারা আসছে?

ফরহাদ মজহার : আমি তো এভাবে প্রেডিক্ট করব না। আমি তো আর গণক না।

আমাদের সময় : আপনার কথা অনুযায়ী, বর্তমান সরকার যে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা বলছে, সেটি কি কেবলই কালক্ষেপণ?

ফরহাদ মজহার : এটি জনগণের চোখে ধুলা দেওয়ার নামান্তর। তারা টিকতে পারছে না। পারবেও না। আজকের মতো দিনে কার এত বড় সাহস হলো যে, আসিফ নজরুলসহ কয়েকজন উপদেষ্টাকে আটকে রাখে! যে জনগণ গণ-অভ্যুত্থান করেছে, সেই জনগণ তো সচিবালয়ে হামলাকারীদের ঠেকাতে যায়নি। এর আগে যখন আনসাররা বিদ্রোহ করে বসেছিল, তখন তো হাসনাতরা (হাসনাত আবদুল্লাহ), সাধারণ ছাত্ররা গিয়েছিল। এখন কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

আমাদের সময় : এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দল ও সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

ফরহাদ মজহার : প্রথম পরামর্শ থাকবে বৃহৎ দল বিএনপির প্রতি। তারা কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেনি।

আমাদের সময় : তারা তো মেনে নিয়েছে।

ফরহাদ মজহার : না, মেনে নেয়নি। সরকারকে মানা আর গণ-অভ্যুত্থানকে মেনে নেওয়া এক বিষয় নয়। আর এটি তো গণ-অভ্যুত্থানের সরকার নয়। এটি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিবিপ্লবী সরকার। বিএনপি যদি গণ-অভ্যুত্থানকে মানতই, তাহলে তারা এই তথাকথিত সরকারকে স্বীকৃতি দিত না। তারা জাতীয় সরকার গঠনে উদ্যোগী হতো, যে সরকার হতো সত্যিকারের জনগণের সরকার। তারা বলতে পারত- আমরা গণ-অভ্যুত্থান করেছি, আমরা শেখ হাসিনার সংবিধান চাই না। বাহাত্তরের পুরনো এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে চাই। বিএনপি তা করেনি। ফলে বিএনপি এখন গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সাম্য, মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েমের জন্য। ফলে বিএনপি কিন্তু একশ ভাগ জিয়াউর রহমানের রাজনীতির বিরুদ্ধে। আমি মনে করি, বাংলাদেশে যতগুলো বড় নেতৃত্ব এসেছে, তার মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান অন্যতম। বাংলাদেশকে মুক্তি দিতে পারেন- এমন দৃঢ় সৈনিক কেবল জিয়াউর রহমান। অন্য কারও মধ্যে এমন দৃঢ়তা দেখা যায়নি।

আমাদের সময় : মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ফরহাদ মজহার : উত্তরণ তো আমার কথার ওপর নির্ভর করছে না। প্রথমত, তাদেরকে গণ-অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিএনপি যদি সত্যিই অভ্যুত্থানকে অ্যালাউ করে, সত্যিই পরিবর্তন চায়, তাহলে তারা সরকার ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিক। গঠনতন্ত্র প্রণয়নের গণপরিষদ গঠন করুক।

আমাদের সময় : সেটা কি নির্বাচনের আগেই করবে, না পরে?

ফরহাদ মজহার : কিসের নির্বাচন? জাতীয় সরকার গঠন একটা পথ হতে পারে। এই সরকারকে পুনর্গঠন করতে হবে। বিএনপিকে মানতে হবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানই মূল গণ-অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। সত্যিকারের জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে, যে সরকারের প্রথম কাজ হবে বর্তমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা।

আমাদের সময় : কিন্তু এটা তো বিপ্লবী সরকার নয়...

ফরহাদ মজহার : কী আশ্চর্য! আমি তো বলেছিই এটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবী সরকার। এই সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবী সরকারের বিষয়টিকে কাটিয়ে উঠতে হবে একটি পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে। এটি নানাভাবে করা যায়। একটি হলো, এটিকে পুনর্গঠন করতে পারেন। আরেকটি হলো, চুপ্পুকে সরিয়ে যেটি পিনাকীও বলেছে, খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপতির স্থানে বসাতে পারেন। এরপর বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন গঠনতন্ত্র রচনা করতে পারেন।