এসির বাজারে প্রাধান্য দেশি প্রতিষ্ঠানের

আবু আলী
২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
এসির বাজারে প্রাধান্য দেশি প্রতিষ্ঠানের

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বছরের অধিকাংশ সময় গরম ও অতিরিক্ত তাপমাত্রায় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে এয়ার কন্ডিশনই একমাত্র ভরসা। তাই একসময় যে এসি ছিল আমদানিনির্ভর আর শহুরে উচ্চবিত্তদের বিলাসিতার পণ্য; আবহাওয়া বদল ও দেশীয় কোম্পানির কল্যাণে দাম সাধ্যের নাগালে আসায়, সেই এসি এখন মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই যুগ আগেও এসির বাজার ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। শুরুতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের এসি আমদানি করা হতো। পরবর্তী সময় দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় চীন থেকে ফ্রিজ-এসি আমদানি শুরু হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত চীনা ব্র্যান্ডের ফ্রিজ-এসি বাজারে রাজত্ব করে। এরপর অবস্থা বদলাতে থাকে।

আমদানিকারকদের অনেকেই চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন শিল্প স্থাপন করেন। শুরুটা ছিল ফ্রিজ সংযোজন দিয়ে। পরবর্তী সময় এসি ও অন্যান্য পণ্য সংযোজন শুরু হয়। সরকার এ সময় নীতিসহায়তা দেওয়ায় দেশে ইলেকট্রনিক্স শিল্প বিকাশ লাভ করে। দেশেই শুরু হয় এসি-ফ্রিজ উৎপাদন।

বর্তমানে দেশে এসি-ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ওয়ালটন, মার্সেল, যমুনা, মিনিস্টার, ট্রান্সটেক, ইলেকট্রা, এলিট, র‌্যাংগস, স্মার্ট, ভিশন, সেইফসহ বিভিন্ন দেশীয় ব্র্যান্ড। এ ছাড়া দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত বিদেশি ব্র্যান্ডের এসির মধ্যে রয়েছে গ্রি, সিঙ্গার, এসিসি, স্যামসাং, হায়ার, হিটাচি, মিডিয়া, এলজি, হাইসেন্স শার্প, জেনারেল, প্যানাসনিক, ডাইকিন প্রভৃতি। যেসব কোম্পানি এখন সংযোজন করছে, তারাও ভবিষ্যতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। এর বাইরে চীন থেকে বিভিন্ন এসি আমদানি হয়। বর্তমানে এসির বাজারে দেশীয় পণ্যের আধিপত্যই বেশি।

ওয়ালটন এয়ার কন্ডিশনারের সেলস কো-অর্ডিনেটর মো. মুহাইমিন উল বারী আমাদের সময়কে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে এসির বাজারের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতিবছরই অসহনীয় গরম, দ্রুত বিকাশমান নগরায়ণ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত এসির সহজলভ্যতা ইত্যাদি নানান কারণে দেশে এসির চাহিদা বাড়ছে। গত বছর দেশে সাড়ে ৬ লাখ এসির চাহিদা ছিল, এটা চলতি বছর সাড়ে ৭ লাখে পৌঁছাতে পারে। সামনের বছরগুলোতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে এসির বাজার বাড়তে পারে।

যমুনা গ্রুপের ডিরেক্টর অব মার্কেটিং সেলিম উল্যা সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, দেশে এসির বাজারের ৭০ ভাগই দেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সাশ্রয়ী মূল্য ও সহজলভ্যতা। গত ১০ বছরে এসির বাজার বড় হয়েছে। একটা সময় এসির দেখা মিলত বড় বড় অফিস আর ধনী লোকের বাড়িতে। এখন প্রতিটি মসজিদ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ক্লাসরুমে এসি আছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এসির চাহিদাও বাড়ছে। দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো তুলনামূলক কম দামে সবার কাছে পৌঁছাতে পারায় মফস্বলে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকারি নীতি সহায়তা চেয়ে সেলিম উল্যা বলেন, এক সময়ের পুরোপুরি আমদানিনির্ভর এই শিল্পে বর্তমানে দেশীয় কোম্পানিগুলো আধিপত্য বিস্তার করছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি এসির মানে কোনো ফারাক নেই। এক সময়ের আমদানি পণ্যটিই এখন আমরা রপ্তানি করছি। তবে আমার মনে হয়, বাংলাদেশের একটা বড় বাজার এখনও আনটেপড আছে। পাশাপাশি এরই মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকায় আমরা আমাদের পণ্য রপ্তানি করছি। বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের পণ্য বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই সরকারি নীতিসহায়তা ও কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলে বাংলাদেশের এসির বাজার আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে।

গত কয়েক বছর ধরে দেশে এসির বাজার বার্ষিক প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এয়ার কন্ডিশনিং ইকুইপমেন্টস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএইআইএ)। তারা বলছে, বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে এ বছর বিক্রি কয়েকগুণ বাড়বে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গ্রাহক এখন আর এসিকে বিলাস পণ্য বলে মনে করছে না বলে দাবি করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, গ্রাহকের চাহিদা বিবেচনা করে আমরা এসি উৎপাদন করছি।

এসি উৎপাদন ও বিপণনকারীরা জানান, দেশে এখন বছরে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়। করোনার আগে দেশে এসি বিক্রি বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছিল। তবে করোনার মধ্যে এসির চাহিদা অনেক কমে যায়। তবে গত দুই বছরে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, চলতি বছর এসি বিক্রি বাড়বে প্রায় ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর ২ দশমিক ২৮ শতাংশ পরিবারে (খানা) এসির ব্যবহার ছিল, যা ২০২২ সালে ছিল ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।