‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিকল্প নয়, অপরিহার্য’
বর্তমানে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান মোট উৎপাদনের মাত্র ২.৯৪%। এই প্রেক্ষাপটে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, কার্যকর নীতিমালা এবং তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
একশনএইড বাংলাদেশ, বুয়েট, জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (জেটনেট-বিডি) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত রিনিউয়েবল এনার্জি ফেস্ট ২০২৫ থেকে এই আহ্বান জানিয়েছেন জ্বালানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবিরের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিইপিআরসির চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে বুয়েটের প্রো-ভিসি ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী; বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ডেলিগেশনের ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড জ্বালানির প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাইফ হোসেন; এএআইবিএসের চেয়ারপার্সন ইব্রাহিম খলিল আল-জায়াদ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. এ. এ. শওকত চৌধুরী।
এখন টেকসই জ্বালানির রূপান্তরে সকলের মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান প্রধান অতিথি বিইপিআরসি-এর চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন, এনডিসি। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। কেউ চাপিয়ে দিবে তা নিয়ে আগানো ঠিক হবে না। গত ১৫ বছরে আমরা শুধু মেগা প্রজেক্টের পেছনে ঘুরেছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সেভাবে টেকসই কোনও কাজের অগ্রগতি হয়নি। ঐতিহাসিকভাবে আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য একেবারে দায়ী নই। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে।”
বাংলাদেশের ইইউ ডেলিগেশনের পরিবহন ও জ্বালানি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাইফ হোসেন বলেন, ‘জ্বালানি ক্ষেত্রকে আরও কর্মদক্ষ করে তুলতে হলে আমাদের সবুজ জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ইউ-এর কাছে ১.৩ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ আছে। তবে বাংলাদেশের জ্বালানির খাতে টেকসই অবকাঠামোর অভাবে বরাদ্দ পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সুষ্ঠু জ্বালানি নীতি কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।’
বুয়েটের প্রো-ভিসি ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের জ্বালানি নীতিগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। টেকসই জ্বালানি রূপান্তর নিশ্চিতে জ্বালানি নিয়ে মহাপরিকল্পনা করার সময় এসেছে। পাশাপাশি আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় এনে ‘বটম-আপ এপ্রোচে’ যেতে হবে।’
একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘নবায়নযোগ্য শক্তিকে বিকল্প নয়, অপরিহার্য হিসেবে দেখতে হবে।’
ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ে এবং নারীবান্ধব টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করতে হবে আমাদের। এই উৎসবে তরুণদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ টেকসই জ্বালানি রূপান্তরের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে বাণিজ্যিকীকরণ না করতে পারলে ৩ শতাংশ জ্বালানি থেকে যাবে। আগাতে পারবো না।’
এছাড়াও, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে স্থানীয় উদ্ভাবকদের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ‘পাওয়ার-পিচ’ নামে একটি বিশেষ পর্বের আয়োজন করা হয়, যেখানে উদ্ভাবকেরা তাদের আইডিয়া তুলে ধরেন।
আজ বৃহস্পতিবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী প্রযুক্তি প্রদর্শন, নীতিগত সংস্কারের আলোচনা এবং তরুণদের সতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সবুজ ভবিষ্যৎ গড়ার আহ্বান জানিয়ে পর্দা নামলো ‘রিনিউয়েবল এনার্জি ফেস্ট ২০২৫’-এর। রাজধানীর বুয়েট ক্যাম্পাসে ২৩-২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দুইদিন ব্যাপী বর্ণীল আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলেছে দেশের ইতিহাসের প্রথম নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক এই উৎসব।
দ্বিতীয় ও সমাপনী দিনে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি মেলায় দেশীয় উদ্ভাবকদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও ধারণা প্রদর্শন করেন। প্রযুক্তি মেলায় কর্পোরেট খাতের প্রতিষ্ঠিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্য ও সেবা তুলে ধরা হয়। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ‘ইয়ুথ হাব’-এ তরুণরা সংলাপ, কর্মশালা ও কুইজের মাধ্যমে তাদের ভাবনা ও উদ্ভাবনী ধারণা সকলের সামনে তুলে ধরেন।
এর পাশাপাশি আজকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে তিনটি সমান্তরাল পলিসি ডায়ালগ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবকাঠামো, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি’ বিষয়ক আলোচনায় ইউআইইউ-এর সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং বিশ্বব্যাংকের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তনুজা ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। একই সময়ে ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থায়ন ও বিনিয়োগ’ নিয়ে একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিসিস (আইইইএফএ)-এর প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম এবং সিটি ব্যাংক পিএলসি ও ইডকল-এর প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন এবং ‘জ্বালানি ও জলবায়ু সুবিচারের জন্য তরুণ’ শীর্ষক আলোচনায় ব্রাইটার্স সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এর চেয়ার ফারিহা সুলতানা অমি এবং ইয়ুথ নেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস-এর নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমানসহ তরুণ জলবায়ু অধিকারকর্মীরা তাদের ভাবনা তুলে ধরেন। প্রতিটি অধিবেশনেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সবশেষে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হয়। টেকসই জ্বালানির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার জন্য ‘রিনিউয়েবল এনার্জি উইনার অ্যাওয়ার্ড’ বিভাগে পুরস্কার পায় প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র খামার। ফিউচার এনার্জি টেকনোলজি অ্যাওয়ার্ড বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ইজিগো স্টার্ট-আপ। দ্বিতীয় স্থান ও তৃতীয় স্থান যথাক্রমে আইইউবি-এর গ্রিন এনার্জি রিসার্স সেন্টার এবং মাটি এগ্রোভলটেক প্রোগ্রাম।
এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ, ইউআইইউ-এর পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী; ঢাকা ব্রিটিশ হাইকমিশনের জলবায়ু ও পরিবেশ উপদেষ্টা এ এস এম মারজান নূর; বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন ডিন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন; সিটি ব্যাংক পিএলসির প্রতিনিধি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, এবং বিএসআরইএ-এর সভাপতি মোস্তফা আল মাহমুদসহ শতাধিক নাগরিক সংগঠন (সিএসও), জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, স্থানীয় সংগঠনের পরিবেশ ও জ্বালানিখাতের বিশেষজ্ঞ, এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।