সালতামামি : নির্বাচন পতন ক্ষমতায়ন
বিশ্বময় নির্বাচনে কেটেছে ২০২৪ সাল। শুরুটা হয়েছিল ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ দিয়ে। এর পর পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকাসহ আরও নানা দেশ হয়ে মার্কিন মল্লুকে। বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে ভয়াবহ পতনও নিশ্চিত হয় দেশটির প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের। ঠিকমতো মাস সাতেকও টিকতে পারেনি শেখ হাসিনার সরকার। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল তার জঘন্য ক্ষমতাচ্যুতি ও গণ-আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায়ন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোড়ে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছর ৭ মাসের শাসনের অবসান ঘটে। এর পর পরই ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ কয়েকটি কার্যালয়ে ব্যাপক হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের বহু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাটেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
একমাত্র গোপালগঞ্জে শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ‘শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’ দাবি করে গত ৫ আগস্টের পর পর বেশ কয়েক দফায়, কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরপরই দলের নেতারা আত্মগোপনে। দলটির কোনো স্তরের কোনো নেতাই আর প্রকাশ্যে নেই। বহু মামলা দায়ের হয়েছে শেখ হাসিনাসহ দলের সব নেতার বিরুদ্ধে। পালাতে না পারা অনেকের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। দাপুটে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বাঘা বাঘা নেতার অনেকে ভারতে আছেন। কেউ কেউ ভারত হয়ে চলে গেছেন নানা দেশে।
এক বছরের মধ্যে দুই কিসিমের দুটি সরকার দেখলো বাংলাদেশ। আগামী বছর আরেকটি দেখার প্রত্যাশা থাকলেও তা ২৬ সালে গড়ানোর নমুনা। নির্বাচন নিয়ে আচ্ছা রকমের রাজনৈতিক জটিলতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজে অরাজনৈতিক বা রাজনীতির উর্ধ্বে; তার যত কাজ রাজনীতিকদের সঙ্গে। তাদের আয়ত্ত্ব করতে, নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টায় যে তার অন্ত নেই; কিন্তু কতটা পারছেন তা গোপন থাকছে না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ তার স্পষ্ট প্রতিপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের বাকিরাও একেবারে পক্ষশক্তি নয়। বিপক্ষে না হলেও নির্মোহ সমর্থক নয়। যথাসময়ে, যৌক্তিক সময়ে, যথাশিঘ্র সংস্কার শেষ করে নির্বাচনÑ এ ধরনের কথায় তারা অসন্তোষ জানাচ্ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবেÑ অবিরাম এ জিজ্ঞাসার জবাব আরেকটু খোলাসা করে যেন ড. ইউনূস আরেক ধরনের ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন। ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে জানিয়েও তিনি বাড়তি ফ্যাসাদে।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করলে আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। এ ধরনের বাক্যে ম্যাসেজ মোটামোটি পরিষ্কার; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সেখানেও বাগড়া। তার এ ধরনের কথার মধ্যে তবে-কিন্তু আঁচ করছে তারা। তাই তারা আরও স্পষ্টতা দাবি করে। যার জেরে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
প্রেস সচিবের বক্তব্যে নির্বাচনের একটা খসড়া রোডম্যাপ মোটামোটি দেওয়া হয়েছে ধরে নেওয়া যায়; কিন্তু বাস্তবে যন্ত্রণা আরও বেড়েছে। তিনি এ তথ্য জানানোর কেÑ এ প্রশ্নও উঠে গেছে। ভাষা বেশি ঝাঁজাল প্রধান দল বিএনপির। প্রধান উপদেষ্টাকে সবাই মিলে, দেশের মানুষ মিলে মনোনীত করেছেন; কিন্তু প্রেস সচিব তো সরকারি চাকরি করেন, সরকারের বেতন নেন, তিনি এ ক্ষমতা পেলেন কোথায়? এখানেই শেষ নয়, প্রেস সচিক প্রধান উপদেষ্টাকেও ক্রস করে ফেলেছেন বলে ক্ষোভ জানানো হয়েছে বিএনপি থেকে। দলটির নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সিপিবির মতে, সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন সম্ভব। সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করলেও নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে চায় না জামায়াত। ২০২৬ সালে নির্বাচন হলে আপত্তি নেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। পছন্দের সময় চায় জাতীয় পার্টি। সেই পছন্দের সময়টা কখন, তা এখনই বলতে চায় না দলটি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও বসে নেই, অপেক্ষায় আছে; তাদেরও আশা আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের পথে নেই বলে মনে করছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। তারা সবার অংশগ্রহণে দ্রুত নির্বাচন চায়। এই দ্রুত মানে কতো দ্রুত বা কখন, সদিকে এখনই যেতে চায় না আওয়ামী লীগ। এর মাঝে নির্বাচনের এ পথে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরে এসেছে। আগামী নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, মানে বর্তমান সরকারটিই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ করবে, তা-ও পরিষ্কার। আদালতের নির্দেশে অবৈধ ঘোষণা করে আংশিক বাতিল করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনী। এর মধ্য দিয়ে ফিরল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি। ১৭ ডিসেম্বর দেওয়া এ রায়ে আদালতের ভাষায় বলা হয়েছেÑ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে।’
গেল কয়েকটি নির্বাচনের মতো তামাশার নির্বাচন যে আগামীতে হচ্ছে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার অংশীদার হতে চায়নি কেউ। সাধারণ জনগণ?ও সকল আশা-ভরসা ছেড়ে দিয়ে চরম হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তারা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেননি, কথা বলেছেন সিভিল সোসাইটির নেতাদের সঙ্গে। রাজনৈতিক শূন্যতার পরিবেশে তখন?ই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব যখন শেখ হাসিনার তক্ত-তাউস ভেঙে চুরমার করে দেয়, তখন সবকিছুই অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ছাত্রদের এই বিজয়ের দাবিদার হতে থাকেন অনেকেই। এটাই জাগতিক নিয়ম। ছাত্ররা তাদের বিজয় অন্য কাউকে হাইজ্যাক করতে দিতে চাইছেন না। বিজয়ের কৃতিত্ব তাই আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। মানে নতুন দল সংগঠিত করছেন।
প্রধান উপদেষ্টার এবারের ভাষণে এ-ও স্পষ্ট সরকার কেবল একটি নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দায়িত্ব শেষ করতে চায় না; তারা জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায়ও নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কমিশন করার কথাও আছে। প্রধান উপদেষ্টার কথা দৃষ্টে নতুন নির্বাচন কমিশনের কাজ চলছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
তাদের এ আয়োজনের মধ্যে বিএনপির কিছু ‘কিন্তু’ দেখার ফের এখনো স্পষ্ট নয়। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোও বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যে রোডম্যাপ নয়, শুধু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চার মাস পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে বক্তব্য এলো কেন এ প্রশ্নও তাদের। বামপন্থি দলগুলোও নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এই দলগুলো সংস্কার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ দিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। তারা মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব। কোনো কোনো ইসলামি দলের প্রতিক্রিয়াতেও একই ধরনের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। রোডম্যাপ প্রশ্নে দলগুলো এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে সংলাপ আশা করছে। এদিকে কথা না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির। সমাবেশ ডেকে তারা জানিয়ে দিয়েছেনÑ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিচারের আগে যারা নির্বাচন চাইবে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের কথা পরিষ্কার; কিন্তু উদ্দেশ্য ঝাপসা।
আবার তাদের পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততার তথ্যও ঘুরছে। এমন কানাঘুষা ও তথ্য কচলানোর মাঝেই মহান বিজয় দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বঙ্গভবনে বিজয় দিবস উদযাপনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করছেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সেল থেকে সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান বিজয় দিবসের মতো জাতীয় গৌরবের দিন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে পালন করাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে করে। এসব অর্থের প্রকাশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা মাঝেমধ্যেই দিয়ে আসছেন।
রাজনীতি, নির্বাচন, সরকার ইত্যাদির বাইরে বাংলাদেশে ঘটে চলা কিছু ঘটনাও ইতিহাসে জায়গা করে নিচ্ছে কালো দাগ হয়ে। নানান জায়গায় হামলা, মিথ্যা মামলা, চুরি, ডাকাতি, নিত্যপণ্যের উচ্চ দরে মানুষের কান্না। তার ওপর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বৈরিতার যে নতুন পরিক্রমা তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন, রাজনীতি, ক্ষমতায়নের উত্থান-পতনকে কোথায় নেবে; সেই জিজ্ঞাসা থেকে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
জোটের ভাগে অনেক নেতা নৌকা হারাবেন
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন