গানের কারণেই সংসার, গানের কারণেই বিচ্ছেদ

বিনোদন প্রতিবেদক
২২ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:১৫
শেয়ার :
গানের কারণেই সংসার, গানের কারণেই বিচ্ছেদ

‘কী ছিলে আমার, বলো না তুমি’ গানটি শুনলেই মনে পড়ে যায় মনি কিশোরের নামটি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গানটি তিনি গেয়েছিলেন বিটিভিতে। ১৯৯১ সালে এটি স্থান পায় শিল্পীর ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামে। শুধু তাই নয়, গানটি জায়গা করে নেয় ওমর সানী-শাবনূর অভিনীত ‘কে অপরাধী’ সিনেমাতেও।এরপর মনি কিশোর কণ্ঠ দেন প্রায় পাঁচ শতাধিক গানে। যার বেশিরভাগ গানই ছিল হিট।

ক্যাসেটের যুগে রাজত্ব করে যাওয়া এই শিল্পী দীর্ঘদিন ধরেই ছিলেন আড়ালে। অবশেষে প্রকাশ্যে এলেন শিল্পী, তাও মৃত্যুর খবরে। গেল শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর রামপুরার নিজ বাসা থেকে জনপ্রিয় এই শিল্পীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আর মনি কিশোরের ইচ্ছাতেই ইসলাম ধর্মমতে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার একমাত্র মেয়ে নিন্তি।

এদিকে নব্বই দশকেই ধর্মান্তরিত হয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন মনি কিশোর। স্ত্রীর নাম শামীমা চৌধুরী। তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান নিন্তি। তবে তাদের সুখের সংসারে ভাঙনের সুর বেঁজে ওঠে অল্প ক’দিনেই। প্রায় দেড় যুগ আগে দাম্পত্য জীবনের ইতি টানেন এই গায়ক। আর স্ত্রী পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।

মনি কিশোর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, শিল্পীর গানের ভক্ত ছিলেন শামীমা চৌধুরী। এরপর তারা সম্পর্কে জড়ান। সমস্যা ছিল দুজন দুই ধর্মের। তাই বিয়ের আগে মনি কিশোর হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। যার কারণে গায়কের দূরত্ব বাড়ে পরিবারের সঙ্গে। আবার এই গানই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। সংসার জীবনের একটা সময় গানের প্রতি তিক্ততা চলে আসে শিল্পীর স্ত্রীর। এ নিয়ে শুরু হয় সংসারে অশান্তির। অবশেষে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেন তারা।

মনি কিশোরের কথায়, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে কিন্তু গান করেই সম্পর্ক হয়েছে। যখন বাসায় আসল, সংসার শুরু করলাম। তখন গানই তার প্রধান শত্রু হয়ে গেল। তাহলে কী করার আছে, কিছুই করার নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক নারী নির্যাতন আছে, হামলা আছে, বিচার আছে, মামলা আছে; আপনারা কেউ জানেন কী ঢাকায় প্রায় এক-দেড় কোটি পুরুষ প্রতিদিন নাস্তা না খেয়ে নির্যাতিত হয়ে অফিসে যায়।’

জানা যায়, মনি কিশোরের পরিবারের সবাই কমবেশি গানবাজনা করতেন। মা নিরুপমা মন্ডলের সংগীতশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় গানের চর্চা। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার অন্য সন্তানেরা পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও মনি মণ্ডলের (মনি কিশোর) ইচ্ছা ছিল শিল্পী হওয়ার। তাই তো পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন গানের চর্চাও। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলা হয়ে একটা সময় গানের টানে থিতু হন ঢাকায় বড় বোনের বাসায়। এই বোনের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে মনি কিশোর নামের কাউকে চিনত না দেশের মানুষ। মন্ডল পরিবারের একজন হয়েই থাকতে হতো তাকে। একটা সময় গীতিকার-সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের মাধ্যমে বিটিভি প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ পান তিনি। হয়েছেন রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পীও।

শিল্পী হওয়ার তাড়নায় ঢাকায় বড় বোনের বাসায় উঠেছিলেন মনি কিশোর। তবে তার দুলাভাই গান গাওয়ার বিষয়টি খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতেন তিনি।

সে ঘটনার বর্ণনা মনি কিশোর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ঢাকায় বোনের বাসায় পাম্পের বালিশ ফুলিয়ে ফুলিয়ে ঘুমাতাম। বড় বোন মায়ের মতো ছিলেন। তার কারণে আমার মনি কিশোর হয়ে ওঠা। আরেকটা কথা, দুলাভাই বাসায় থাকা অবস্থায় রুমে ঢুকতাম না, বিরক্তি বোধ করবেন ভেবে। তিনি যখন বাসায় থাকতেন, আমি বাসার সানসেটে ঘুমাতাম। এরপর বাসা থেকে চলে গেলে ঘরে এসে ঘুমাতাম। ওর বাসায় সেই আশ্রয়টুকু না পেলে মনি কিশোর হতে পারতাম না। হয়তো সেই মন্ডল বংশে ফিরে যাওয়া লাগত।’

ঢাকায় একদিন দেখা হয় গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের সঙ্গে। তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি মনি কিশোরকে একদিন বিটিভিতে নিয়ে যান, দেখা করিয়ে দেন ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম গান গাওয়ার ঘটনার কথা গণমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন এভাবে- ‘মিল্টন খন্দকার আমাকে বললেন, ‘আপনাকে ফিরোজ মাহমুদ সাহেবের কাছে নিয়ে যাব।” জানতে চাইলাম, উনি কে? বললেন, “গেলেই বুঝতে পারবেন।” একদিন গেলাম। ক্যাসেটে গান রেকর্ড করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন সেখানে সাবিনা (ইয়াসমীন) আপা, নজরুল ইসলাম বাবু ভাই, আলীমুজ্জামান দুলু ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। বিটিভির নির্বাহী প্রযোজক ফিরোজ মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে মিল্টন খন্দকার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এভাবে, “আমি তো সংগীতের মানুষ, যারা সংগীত প্রবাহ ও গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গান গায়, তাদের চেয়ে এ (মনি কিশোর) অনেক ভালো গাইবে। না গাইলে তখন আমাকে বইলেন।” এরপর গান শুনলেন। ফিরোজ ভাই যখন গানটা শুনছিলেন, হঠাৎ বাবু ভাইও চুপ হয়ে গেলেন। একটা সময় পুরো ঘর চুপচাপ হয়ে গেছে। সেদিনই তিনি বিটিভির গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গাইবার সুযোগ করে দেন।’

প্রথমবার টেলিভিশনে গাইবেন; তাই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন মনি কিশোর। আর সে কারণে বিটিভি থেকে বেরিয়ে জামাকাপড় কিনতে ছুটে যান গুলিস্তানে। শিল্পীর কথায়, ‘গুলিস্তানে গিয়ে একটা শার্ট কিনলাম ৬০ টাকা দিয়ে। আরেকটা কালো রঙের গেঞ্জি কিনলাম ২০ টাকা দিয়ে। পরদিন বিটিভিতে গেলাম। আলম আরা মিনু, হাসান চৌধুরী, ডলি সায়ন্তনীও ছিলেন। একটা সময় আমার গান রেকর্ডিংয়ের পালা আসে। রেকর্ডিং শেষে আমি দেড় হাজার পোস্ট কার্ড কিনেছিলাম। খালি লিখি আর পাঠাই। বন্ধু, পরিচিতজন সবাইকে পাঠিয়েছি। শুধু লিখেছি, আমার গাওয়া গানটা অমুক দিন যাবে, দেখতে হবে কিন্তু। রাত-দিন খালি চিঠি লিখি। শুধু যশোরে ৫০০ থেকে ৭০০ পোস্ট কার্ড পাঠিয়েছিলাম। এর বাইরে ফরিদপুরসহ যেখানে যেখানে থেকেছি।’

গানের তালিম নেওয়া হয়নি কোনো দিন মনি কিশোরের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হারমোনিয়ামের হা-ও কিন্তু জানি না। আর সারেগামারও সা-ও জানি না। বলতে পারেন, আমি একটা ফটোকপি শিল্পী। আমাকে যে সংগীত পরিচালক যা শিখিয়ে দিতেন, আমি তাই গেয়ে দিতাম। কাচের ওপাশ থেকে যা শোনাতেন, তাই গেয়ে দিতাম। আমার কান দুটোই ছিল সম্বল। এদিকে গান প্রচারের আগে শুনলাম, কে বা কারা ওই সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন, অডিশন ছাড়া একজন শিল্পী আছে গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে, যাকে টাকার বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই। নিয়মিত শিল্পীদের বাদ দিয়ে এই শিল্পীকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে! এরপর তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীকে ফিরোজ মাহমুদ ভাই পুরো অনুষ্ঠানটা শুনিয়েছেন।’

মনি কিশোর আরও বলেন, ‘গান শোনার পর তিনি (তথ্যমন্ত্রী) বলেছিলেন, এই শিল্পীর অডিশনের কোনো দরকার নেই। রেডিও এবং টেলিভিশনের মূল কাজই হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিভা খুঁজে এনে প্রতিষ্ঠিত করা। পরীক্ষা দিয়ে শিল্পী হওয়ার সুযোগ এখানে নেই। নির্ধারিত তারিখে আমার গাওয়া “কী ছিলে আমার” গানটা প্রচার হলো না। এই ঘটনার পর, আমি দু’দিন কিছু খাইনি। অনেক কান্না করেছি। চিন্তা করলাম, শিল্পীই আর হব না। এরপর একদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়েছি, তখন মিল্টন বললেন, “তোর গানটা বোধ হয় পরশু দিন যাবে।” আমি তখন বলেছি, গেলে যাক। আমি কাউকে কোনো চিঠিও লিখব না। কিচ্ছু করব না। অনুষ্ঠানও দেখব না। এবং কিছু করিওনি, টেলিভিশনটা খুলি নাই। ভেবেছি, আবার হয়ত প্রতারণা হবে। কিন্তু ঠিকই গানটা প্রচারিত হয়। শুধু টেলিভিশনেই এই গান প্রচারের চিঠি আসছে ৫ থেকে ১০ হাজারের মতো। আর আমার ঠিকানায় বলা যায় প্রতিদিন বস্তায় বস্তায় আসত।’

মনি কিশোর মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তারই সুর করা ও লেখা। মাঝে দীর্ঘদিন নতুন গান প্রকাশ থেকে দূরে ছিলেন এই গায়ক।

চলতি বছর এক সাক্ষাৎকারে গায়ক জানান, তিনি আবার নতুন গান করছেন। আর পুরোনো গানগুলো প্রকাশ করছেন ইউটিউবে। শুধু তাই নয়, ‘কী ছিলে আমার’ গানটি নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি।

তার ভাবনাগুলোও জানিয়েছিলেন তিনি। জানান, এ প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি শুনেছেন। ইউটিউবে প্রচুর ভিউ। স্টেজে গেয়ে থাকেন তরুণেরা; কিন্তু গানের মূল গায়ককে তারা চেনেন না। গানটির সুরকার ও গীতিকার কে, তা জানেন না। এ রকম জায়গা থেকে ভেবেছেন, এ প্রজন্মের কাছেও গানটি পরিচিত হোক। তাদের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আলাদা করে দেড়’শ গান তৈরি করেছেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘গানগুলো আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে চাই না। কিছু গান মৃত্যুর পরও প্রকাশ পাবে।’

জীবদ্দশায় মনি কিশোর তার এই গানগুলো প্রকাশের আগেই চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। এই শিল্পী যেমনটি চেয়েছিলেন, হয়তো সেই ইচ্ছা পূরণ করবে তার পরিবার। শিগগিরই প্রকাশ্যে আসবে তার তৈরি হওয়া গানগুলো।

শিল্পী হিসেবে মনি কিশোরের আলাদা একটা গণ্ডি ছিল বলে মনে করতেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকের একটা আলাদা গণ্ডি আছে। আমার যেমন মেয়ে ভক্তরা বেশি, বিশেষ করে গার্মেন্টসের। আমার কিন্তু ড্রয়িংরুমের, মানে গুলশান-বনানী ও ধানমন্ডির শ্রোতা নেই। আমার শ্রোতা রিকশাওয়ালা, বিশেষ করে গার্মেন্টসের। এই রিকশাওয়ালা ও গার্মেন্টসের মানুষেরা আমাকে মনি মন্ডল থেকে মনি কিশোর করেছে। ওরাই আমার জীবনের সব।’

এ দেশে মনি কিশোর আর জন্মাবে না বলেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। গায়কের কথায়, ‘ব্যক্তি মনি কিশোর আর গায়ক মনি কিশোরের আকাশ-পাতাল তফাত। কোনো মিল নেই। চরিত্রের মিল নেই, কথাবার্তার মিল নেই, চালচলনের মিল নেই। মানুষ মনি কিশোর যখন মাইক্রোফোন হাতে নেয়, তখন সে অন্য এক মনি কিশোর হয়ে ওঠে। অসাধারণ গায় সেই মনি কিশোর। আমি শ্রোতা হিসেবে শিল্পী মনি কিশোরের গান দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুনেছি। শ্রোতা হিসেবে বলছি, শিল্পী মনি কিশোর জন্মাবে না আর।’

উল্লেখ্য, পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সাত সন্তানের মধ্যে মনি কিশোর চতুর্থ সন্তান। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাই মারা গেছেন। দেড় যুগ আগে মনি কিশোরের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে একা থাকতেন। তার একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। নড়াইল জেলার লক্ষ্মীপুরে মামাবাড়িতে ১৯৬১ সালের ৯ জানুয়ারি জন্ম মনি কিশোরের। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তার।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের ‘কী ছিলে আমার’ শিরোনামের একটি গান মনি কিশোরকে প্রতিষ্ঠিত ও ব্যাপক পরিচিত করে দেয় সংগীতাঙ্গনে। এরপর একে একে প্রকাশ হলো শিল্পীর প্রায় পাঁচ শতাধিক গান।