কারওয়ানবাজারে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য দখলে মরিয়া ৫ গ্রুপ
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের মাঝামাঝিতে অবস্থিত বহুতল ভবন ‘ভিশন ২১ টাওয়ার’। এই টাওয়ারের পাশেই রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের কার্যালয়। কারওয়ানবাজারের পরিবহন (ট্রাক, পিকআপ ও ভ্যান) ও ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ হতো এ কার্যালয় থেকে। গত ৫ আগস্ট দুপুরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের খবর চাউর হলে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ভাঙচুর চালায় এ কার্যালয়ে। এর আগেই পালায় দলীয় কর্মীরা। গতকাল সোমবার দুপুরে শ্রমিক লীগের ওই কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শ্রমিক লীগের পরিবর্তে ঝুলছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের ব্যানার। কারওয়ানবাজারে এখনো পুরোদমে বখরাবাজি শুরু না হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের গড়া চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য দখল হয়ে গেছে বলে অভিমত ব্যবসায়ীদের। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেমের নেতৃত্বে চলা শুধু শ্রমিক লীগের কার্যালয়টিই নয়; তেজগাঁও থানা এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং এর আরও কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয় থেকেও নিয়ন্ত্রণ হতো কারওয়ানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি। এর মধ্যে রয়েছে তেজগাঁও থানা যুবলীগের একটি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের একটি, কৃষক লীগের একটি, ১ নম্বর রেলগেটে ছাত্রলীগের একটি, থানার অন্তর্গত আওয়ামী লীগের ১১টি ইউনিট কার্যালয়। এসব কার্যালয় থেকে কারওয়ানবাজারের ফুটপাত, পরিবহন, মাছ বাজারসহ ১৩টি খাত থেকে দৈনিক ১ কোটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হতো।
চাঁদাবাজির বিশাল এই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হতো তেজগাঁওয়ের মনিপুরিপাড়া লায়ন মার্কেট কমপ্লেক্সের দোতলায় অবস্থিত তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে। দৈনিক চাঁদার টাকা এক জায়গায় করে তা পুলিশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় সাংবাদিকের কাছে ভাগ-বণ্টনের দায়িত্বে ছিলেন তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক আলমগীর হোসেন লাতু। আর তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আব্দুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক শামীম হাসান শামীমের (২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর) মাধ্যমে চাঁদার ভাগ পৌঁছে যেত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে।
গত ৫ আগস্টের আগের রাত পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক চললেও সেদিন দুপুরের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ভাঙচুর চালায় এই থানা এলাকায় থাকা আওয়ামী লীগ ও এর সবকটি অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয়ে। কোনোটিতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এখন কারওয়ানবাজারকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির এক-একটি খাত দখলে নিতে টার্গেট করে রাতে বিভিন্ন সংগঠনের নামে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মহড়া চলছে।
জানা গেছে, কারওয়ানবাজারের মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করা হতো কিচেন মার্কেটের ছাদের ওপর ঢাকা মহানগর উত্তর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের কার্যালয় এবং শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেমের কার্যালয় থেকে। কারওয়ানবাজারের চাঁদাবাজির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন লোকমান হোসেন। এই লোকমান ও কাশেম পালানোর পর এই দুটি অফিস নিয়ন্ত্রণে নেয় বেলাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। আগে মাছ বাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হতো জাতীয় শ্রমিক লীগ তেজগাঁও থানার কার্যকরী সম্পাদক ও থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক মোশারফ হোসেনের কার্যালয় থেকে। এই সিন্ডিকেট এখন জালাল মোল্লা, জসিম ও অপুর ভাগিনার দখলে। এ ছাড়া আজিজুর রহমান, মুসা, বাবু, মাসুদও দখলে রেখেছেন একাধিক খাত। তাদের শেল্টার দিচ্ছেন আনোয়ার ও এল রহমান। নেপথ্যে আছেন নিরব।
তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, সেনাসদস্যদের পাহারায় তেজগাঁও থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে। আহত দুজন ছাড়া আমাদের সব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। সেনাসদস্যদের নিয়ে আজকেই আমরা প্যাট্রোলিং কার্যক্রম শুরু করছি। চাঁদাবাজরা আপাতত ঠাণ্ডা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, সাবেক নেতাদের সীমাহীন চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ীরা। চাঁদা দিতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে বা প্রতিবাদ করলে তাকেই তুলে নিয়ে যেত সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে করা হয়েছে এলাকা ছাড়া। চাঁদাবাজরা এতটাই ক্ষমতাধর ছিল যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জানালেও কাজ হয়নি।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
চাঁদাবাজদের আক্রমণের শিকার হয়ে মো. শাহাদাত হোসেন সর্দার ও মো. জসিম পাটোয়ারী নামে দুই ব্যবসায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা তেজগাঁও থানায় অসংখ্য সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। দিয়েছেন মৌখিক অভিযোগও। তবে চাঁদাবাজদের সঙ্গে সখ্য থাকায় ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। লোকমান ছাড়াও মিজান, সায়েম ও হেলালসহ দেড়শ চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী একরকম জিম্মি করে রেখেছিল সাধারণ ব্যবসায়ীদের। চক্রটি কারওয়ানবাজারের ১৭ পট্টির ছোটবড় হাজারও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নিত। এর মধ্যে মাছ বাজার থেকেই আসত দৈনিক ২০ লাখ টাকা। রাস্তায় ঘাটে ঘাটে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকেও। এসব কারণে সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের ভগ্নিপতি আমির চেয়ারম্যান, হান্নানের চাচাতো ভাই তাজু, হান্নানের ভাতিজা শাহীন ও মিন্টু, নাজমুল আলম রনি, হান্নানের সাবেক সহযোগী দাঁড়িওয়ালা বাশার, শীর্ষ সন্ত্রাসী আলীর ছোট ভাই চাকমা আক্তার, খালেদ রানা, ফাহিম, মো. আলী, সবুজ, নাডা জসিম, টিপু সুলতান, আক্তার, হুমায়ুন, বিএসসি ফারুক, জসিম, আমজাদ হোসেন খাঁন, বাদল ব্যাপারী, কালা মোস্তফা, রাজিব হোসেন জয়, হান্নান, মফিজ মাঝির চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিলেন ব্যবসায়ীরা। খুনসহ নানা ধরনের হুমকি দিয়ে অগ্রিম ও মাসিক চাঁদা আদায় করে আসছিল তারা।
কাওরানবাজারের ফলপট্টি, ওয়াসাপট্টি, এরশাদপট্টি, সিটি করপোরেশনের সামনে, হোটেল ঝাড়ুপট্টি, জুতাপট্টি, আলীপট্টি, রেলওয়েপট্টি, কিচেনপট্টি, মুরগিপট্টি, সুরমাপট্টি, মুড়িপট্টি, একুশে টিভিপট্টি, পেঁপেপট্টি, লাল বিল্ডিংয়ের পূর্ব ও দক্ষিণপট্টি, মসজিদপট্টি ছাড়াও কয়েকটি পট্টি থেকে লোকমান বাহিনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতি রাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাঁচামাল নিয়ে কারওয়ানবাজারে আসা সহস্রাধিক ট্রাক থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করত চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে কারওয়ানবাজারের একানব্বই জন ব্যবসায়ীর নাম-ঠিকানা ও কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মাসিক কত টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হয়, তা উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগ দেন চাঁদাবাজির শিকার জসিম পাটোয়ারী।
আরও পড়ুন:
জোটের ভাগে অনেক নেতা নৌকা হারাবেন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিএমপি কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগে ব্যবসায়ীরা জানান, কারওয়ানবাজার কিচেন মার্কেটের নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ৪৫০ দোকান থেকে দোকানপ্রতি মাসে ১ হাজার ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে সন্ত্রাসীরা। ওয়াসা গলির ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসে জনপ্রতি আদায় করা হয় ২৫ হাজার টাকা চাঁদা।
সরকার পারিবর্তনের পর কারওয়ানবাজারে স্থানে স্থানে চাঁদাবাজি এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। আগের চাঁদাবাজাদের জায়গায় চলে আসছে নতুন মুখ। গত ৪ দিনে নতুন করে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছে কয়েকটি পক্ষ। এসব ব্যক্তি নিজেদের বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী বলে ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ কেউ চাঁদার টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিকাশ নম্বরও দিয়ে গেছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে।