পাশার দান কোন দিকে
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
অন্তত দুবার মুখ থুবড়ে পড়েছেন তিনি। একবার সভামঞ্চে, আরেকবার বিমানের সিঁড়িতে। গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে ঘটেছিল বলেই হয়তো সে দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন বিশ্ববাসী। তখনই গুঞ্জন উঠেছিল, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন জো বাইডেন। মহাশক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার এমন দুবলা হওয়া বেমানান। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মতো পেশিবহুল না হন, অন্তত শক্ত পায়ে হেঁটে-চলে বেড়াতে তো হবে। তোয়াক্কা করেননি জো। কাউবয় ঐতিহ্যের লোক। উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বয়স বলে কথা। ৮১ বছরের পুরনো শরীরে আর কুলোয় না, মস্তিষ্কের ধারও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। সেজন্যই ইউক্রেনি জেলেনস্কির নাম নিতে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের নাম নেন, নিজেকে বলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তারপরও অবস্থান পরিবর্তন করেননি। বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার অংশ নেবেন। তাকে প্রার্থী করতে তার ডেমোক্র্যাটিক দলের ভেতরেই আপত্তি ছিল। তিনি কর্ণপাত করেননি। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে কেবল ঈশ^রই থামাতে পারেন, ঈশ্বর বললে কেবল তখনই তিনি এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। আর কারও কথা শুনবেন না। অনেকেই বলেছিল। শোনেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরে গেছেন জো। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস থেকে ভাষণ দিয়ে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশ নিচ্ছেন না। তাহলে কি...হ্যাঁ, প্রশ্নটা সবার মাথাতেই আসবে, তার সঙ্গে কি ঈশ^রের কথা হয়েছে?! ঈশ^র তাকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করেছেন?! তাই কি তিনি সরে দাঁড়ালেন?!
প্রশ্ন যাই আসুক মাথায়, জো কিন্তু এখন বলছেন ভিন্ন কথা। বুধবারের ভাষণে তিনি বলেছেন, ডেমোক্র্যাটিক দলের ঐক্য অক্ষুণ্ন রাখতে এবং দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, এখন নতুন প্রজন্মের হাতে মশাল তুলে দেওয়ার সময় হয়েছে। এই বক্তব্য বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে খুবই সময়োপযোগী ও মানানসই, দুনিয়ার সব বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়সের ভারে ন্যুব্জ রাজনীতিকের পক্ষে শিক্ষণীয়, কিন্তু সিদ্ধান্তটা জো নিয়েছেন চাপের মুখে। সেই চাপ আসছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে। নির্বাচন থেকে তাকে সরে দাঁড়ানোর চাপ দিচ্ছিলেন তারা গত জুন মাস থেকেই, যখন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বিতর্কে পরাস্ত হয়েছিলেন তিনি। তাহলে ঈশ^রের কথাটা ছিল তার বাহানা। যাই হোক, সরল কথায় জো বাইডেন সরে দাঁড়িয়ে তার জায়গায় প্রার্থী হিসেবে যার নাম উচ্চারণ করেছেন তিনি বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, তার প্রতি জোর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন জো। তবে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী কে হচ্ছেন, কমলা না অন্য কেউ, সেটা চূড়ান্তভাবে জানা যাবে আগামী আগস্টে। যিনিই দলের মনোনয়ন পান না কেন, নভেম্বরে তাকে মুখোমুখি হতে হবে ট্রাম্পের।
ডেমোক্র্যাটদের বিপরীতে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী। জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার আগের মেয়াদে ট্রাম্পই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। বিশ^বাসীর কাছে তিনি সুপরিচিত। তার বয়স ৭৮ বছর। বাইডেনের চেয়ে শক্তপোক্ত হিসেবে নিজেকে জাহির করার প্রবণতা আছে তার। কয়েকদিন আগে মারাই যাচ্ছিলেন আততায়ীর গুলিতে। কানের পাশ দিয়ে নয়, কান ফুটো করে বেরিয়ে গেছে গুলি। একটুর জন্য রক্ষা। ঘটনার সময় রক্তাক্ত অবস্থাতেও মুষ্টি বাগিয়ে তাকে বলতে শোনা গেছে- ‘লড়াই! লড়াই! লড়াই!’ লড়াই অবশ্য তাকে করতে হয়েছে নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হতে। তিনি যাতে প্রার্থী হতে না পারেন, তার জন্য আইনের মারপ্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। জাল কেটে বেরিয়ে এসেছেন। প্রার্থীও হয়েছেন। নির্বাচনের ময়দানে জো যে তার খুব দুর্বল প্রতিপক্ষ, সে কথা এতদিন একবাক্যে স্বীকার করে আসছিলেন অনেকেই। ডোনাল্ড বর্ণবাদী, এমনকি একনায়ক-ফ্যাসিস্ট, এ অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে তার অভিবাসন নীতি নিয়ে। তা সত্ত্বেও আসন্ন নির্বাচনে ডোনাল্ডের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন অস্বীকার করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব পাওয়া অভিবাসীরাই এ কথা বলছিলেন। এই তো গত বুধবারের কথা, ডোনাল্ডকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব পলিস অর্গানাইজেশনস (ন্যাপো)। সারা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ইউনিয়নগুলোর জোট এটি। এতে যুক্ত আছেন ২ লাখ ৪১ হাজার পুলিশ কর্মকর্তা। তবে, ডোনাল্ডের পক্ষে জনসমর্থন থাকলেও, পাশার দান হয়তো কাত হয়ে যেতে পারে জো দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ায়। কারণ নড়বড়ে জো বাইডেনের চেয়ে শক্তিশালী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেশি পছন্দ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা। এখন বাইডেনের সরে যাওয়া আর কমলা হ্যারিসের সামনে আসার ঘটনায় পাশার দান কোন দিকে ঘুরে যায়, চিন্তার বিষয়। যদিও ডোনাল্ড স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গলা উঁচিয়ে বলেছেন, এতে তার পক্ষে বিজয় অর্জন আরও সহজ হলো।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
মিথ্যা বলার পুরনো অভ্যাস আছে ডোনাল্ডের। যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময় কত দিনে কত মিথ্যা বলেছেন তার পরিসংখ্যান দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট। তাতে দেখা যায়, ৪ বছরে ডোনাল্ড মিথ্যা বলেছিলেন বা মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছিলেন ৩০৫৭৩টি। বললে অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়, বড় মাপের মিথ্যাবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে জো বাইডেনকে পরাভূত করা যত সহজ ছিল, কমলা বা অন্য কাউকে পরাজিত করা ততটা সহজ নাও হতে পারে। সময়ই বলে দেবে উত্তর।
কমলা হ্যারিসের হাতে খুব বেশি সময় থাকছে না। পার্টি তাকে মনোনীত করলেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে আগস্টে। ওদিকে নভেম্বরেই নির্বাচন। সুতরাং সময় বেশি নেই। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সাবেক সিনেটর কমলার বয়স ৫৯ বছর। জো তার ভাষণে বলেছেন, কমলা কঠোর, দক্ষ ও যোগ্য। এরই মধ্যে হুল ফোটাতে শুরু করেছেন ডোনাল্ড, বলেছেন, কমলা চরম-বামপন্থী, পাগলী। জো বাইডেনের প্রচারাভিযানের ব্যবস্থাপক জেন ও’ম্যালি ডিলন এখন কমলার ব্যবস্থাপক। তিনি অবশ্য বলেছেন, কমলা জয়ী হতে চলেছেন। যাই হোক, কমলা জয়ী হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এমন এক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ৫ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি রয়েছে এ নির্বাচনের দিকে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ায়নি বটে, কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট উপেক্ষা করে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মিতালি পাতিয়ে দেওয়া, ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়কদের হত্যা ও দেশটির ওপর হামলার হুমকি, অভিবাসী বিরোধী পদক্ষেপ ইত্যাদি নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে পৃথিবী অস্থির রেখেছিলেন ট্রাম্প। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কম যান না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে মদদ দিচ্ছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পৈশাচিক হামলা-হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে চলেছেন। কমলা হ্যারিস তারই উত্তরাধিকারী। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনিই জয়ী হয়ে আসুন, শান্তিকামী বিশ্বজনতার জন্য তা সুবাতাস বয়ে আনবে কতটুকু? নভেম্বর আসুক। অপেক্ষা করুন।
আরও পড়ুন:
জোটের ভাগে অনেক নেতা নৌকা হারাবেন
প্রমিত হোসেন : সাহিত্যিক। ফিকশন, নন-ফিকশন বইয়ের অনুবাদক। আমাদের সময়ের সহযোগী সম্পাদক