রাজাবলি: ঐতিহাসিক সময়ের রাজমঞ্চ

শামস সাইদ
০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:১২
শেয়ার :
রাজাবলি: ঐতিহাসিক সময়ের রাজমঞ্চ

ড. মুকিদ চৌধুরী, বহুমাত্রিক লেখক ও গবেষক। শিল্পের বহুবিধ ধারায় তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছে বহুরৈখিক মত ও পথের মধ্য দিয়ে। যেখানে স্থান পেয়েছে জাতির শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মকর্ম, নাটক, নৃত্য-সংগীত, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য। যার মধ্য দিয়ে জাতির হৃদয়ে পাপড়ি মেলে বিকশিত হয়েছে নবচিন্তা-চেতনা। এই বিকাশের সাধনাই জাতির সত্য ও সুন্দরের সাধনা পূর্ণতার অভিমুখে অপূর্ব যাত্রা। সে যাত্রাপথ সুগম করতে ভাষা ও চিন্তার উন্নত নান্দনিকতা প্রয়গে শিল্প সৃষ্টিতে নিমগ্ন হয়েছেন তিনি। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার রচিত ‘রাজাবলি’ নাট্যোপন্যাসের ভেতর। 

এই নামটির মধ্যেই রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক অনুসঙ্গ। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ্যমানিক্য-এর শাসনকাল অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছরের আগের সময়কে লেখক মঞ্চস্থ করেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে ছিড়ে এনে। সেই সময়কে জীবন্ত করে তুলেছেন ঐতিহাসিক চরিত্র নির্মাণ করে কাল্পনিক সংলাপ মুখেজুড়ে দিয়ে। নাটকে শুধু পর্দার দৃশ দেখতে পায় দর্শক। কিন্তু নাট্যোপন্যাসে পর্দার ভেতরের দৃশ্যও উম্মুক্ত। অর্থাৎ গল্পের ভেতরের গল্পটাও তুলে ধরেছেন নিপুণ কারিগরের মতো। যা ৫০০ বছর আগের সময়কে করেছে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত। পাঠকের সঙ্গে ঘটিয়েছেন ইতিহাসের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।   

 রাজাবলি নাট্যোপন্যাসটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভাজন করা হয়েছে। যাকে ঘিরে রচিতি হয়েছে এই আখ্যান, তিনি গোবিন্দমানিক্য, ত্রিপুরার মহারাজা। রয়েছেন তার ভ্রাতা নক্ষত্ররায়। ভুবনেশ্বরী-দেবী-মন্দিরের পুরোহিত বা চোন্তাই রঘুপতি। রাজ্যত্যাগী রাজপুত রাজকুমার পুস্কর। ভুবনেশ্বরী-দেবী-মন্দিরের দেবদাসী দময়ন্তী। তার সখী মনোরমা। আরও আছেন মহামন্ত্রী। ভুবনেশ্বরী-দেবী-মন্দিরের প্রধান দেবদাসী সত্যবতী। এ ছাড়া গ্রামবাসী ও প্রহরী। 

মাত্র কয়েকটি চরিত্র আর সল্প সময়ের এই নাট্যেপন্যাসে ড. মুকিদ চৌধুরী কালের গর্ভ থেকে তুলে এনেছেন মহাকাল। তুলে ধরেছেন সেই সময়ের চিত্র, প্রকৃতি, চিন্তা-চেতনা আর ভাষা। যা এই নাট্যেপন্যাসকে করে তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। নাটকের সার্থকতা পূর্ণরূপ লাভ করে সংলাপে, সেখানেও সার্থকতার সাক্ষর রেখেছেন পূর্ণ শক্তিতে। ভাষা ও শব্দের নান্দনিক এমন কারুকাজ করেছেন যা পাঠক কিংবা দর্শককে বিমোহিত করে তুলবে। 

শুরুতেই লেখক গোমতি নীদকে কেন্দ্রকরে প্রকৃতির যে অপরূপ শব্দচিত্র এঁকেছেন তা ধ্যানমগ্ন কোনো মহৎ চিত্রকরের আঁকা ক্যানভাস ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই দৃশ্যের শেষে আমরা দেখা পাই রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের। যে উদাসী ও অতিশয় শিকার প্রিয়। যার ভেতর রয়েছে মহারাজার আসনে বসতে না পারার ক্ষোভ। পিতার মৃত্যুর পরে তার আসনে অধিষ্ঠান করেন মহারাজা গোবিন্দ্যমাণিক্য। সেটা পিতার-ই নির্দেশ ছিল। রাজ্যবাসীর জন্য তাকে দক্ষ ও যোগ্য মনে করেছিলেন পিতা। কিন্তু নক্ষত্ররায় তা মানতে না রাজ। সে ক্ষোভ নিভৃত থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কৃষ্ণহংস বধ করার মধ্য দিয়ে। 

শতাধিক কৃষ্ণহংস বধ করেও অতৃপ্ত ছিলেন নক্ষত্ররায়। তীর ছুড়তে থাকলেন কৃষ্ণহংস নিশানা করে। তীরবিদ্ধ একটি কৃষ্ণহংস এসে পড়ল মহারাজার সামনে। তখন উদ্যানে পরিভ্রমণ করছিলেন তিনি। আহত পাখিটাকে অতিযত্নে তুলে নিলেন। ব্যথিত হলো তার হৃদয়। ভাইয়ের ঠিক বিপরীতে অবস্থান। সে পাখিটাকে নক্ষত্ররায়ের হাতে তুলে দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন। এটাকে সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তুলবেন। কিন্তু নক্ষত্ররায় তা মানতে না রাজ। হঠাৎ ফুঁসে উঠে ভ্রাতার ওপর বিদ্রোহী হয়ে উঠল তার মন। সে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভেরই প্রকাশ। কারণ, ভ্রাতার সঙ্গে সখ্য কিংবা সুসম্পর্ক ওই অর্থে গড়ে ওঠেনি তার। ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা অনুরাগ ও ভক্তি নেই অন্তরে। ভাইকে মনে হয় নিষ্ঠুর রাজা। যে তার অধিকার হরণ করে রাজ্যাসনে অধিষ্ঠান লাভ করেছেন। 

কিন্তু মহারাজার মনে রয়েছে মানবপ্রেম, জীবপ্রেম। তিনি চাচ্ছেন না অকারণে কিংবা কারও মনের একান্ত খেয়ালে জীববধ হোক। রজ্যের সর্বত্রই এই হুকুম জারি করতে মনোস্থির করলেন তিনি। আর রক্তপাত নয়, জীবহত্যা নয়। দেবীকে তুষ্ট করার জন্যও জীববধ করা যাবে না। কিন্তু বাধ সাধলেন রঘুপতি। এ কথা শোনা মাত্রই বিষাদ ও আতঙ্কে ছেয়ে গেল তার মুখ। এ তো ভারি অমঙ্গলের কথা। বহু বছরের প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন মহারাজা। তাদের কথোপকথনে তা উঠে এসেছে এভাবে। 

রঘুপতি: আপনি নিশ্চয়ই কৌতুক করছেন। মা এতদিন ধরে জীবের রক্ত পান করে আসছেন, হঠাৎ তার এমন বাসনা জন্ম নিল কেমন করে?

গোবিন্দমাণিক্য: না, পান করেননি, বরং রক্তপাতে তিনি বিমুখ, মুখ ফিরিয়ে নেন।

রঘুপতি: মহারাজ সন্দেহ নেই, আপনি রাজকার্যে অতি উত্তম, আর আমি ধর্মকাজে। মায়ের সেবায় যে বদ্ধপরিকর সে কি পারে দেবীসেবা অন্যের হাতে তুলে দিতে! দেবীর যদি কিছুতে অষোন্তষ হয়, তাহলে আমিই সবার আগে তা জানতে পারতাম।

গোবিন্দমাণিক্য: হৃদয় যার কঠিন, সে কী দেবীর কথা শুনতে পায়!

রঘুপতি: মহারাজ, আপনি অধর্মের পথে পতিত হচ্ছেন।

মাহারাজ গোবিন্দমাণিক্যকে যখন কোনোভাবেই রাজি করাতে পারলেন না, বা তার স্থির সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারলেন তখন ক্রোধ প্রশমিত করতে কিংবা দেবীকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে অন্যপথে হাঁটলেন রঘুপতি। মনস্থ করলেন পশু নয় সয়ং রাজরক্ত দিয়েই দেবীকে খুশি করবেন। লেখক তা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে তবু তার রক্তে দুরন্ত ক্ষোভ, কোষে কোষে প্রবল প্রতিহিংসার আগুন।’ 

এখানে আমরা দেখা পাই রঘুপতির ভ্রাতাস্পুত্র পুস্করের। সে জানতে চায় এর প্রতিকার। রঘুপতি বলেন, ‘মা হৃদয়হীন। এই শক্তির সন্তোষই হচ্ছে রক্ত পান। বলি চান।’  

রঘুপতির কথা তার মনে বিশাল প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ‘যা তার অশৈশব বিশ্বাসের মূলে অবিশ্রাম আঘাত করতে লাগল। পুষ্কর পীড়িত, ক্লিষ্ট হতে লাগল। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো ভাবনাগুলো কিছুতেই ক্ষান্ত হতে চায় না। যে দবীকে পুষ্কর এতদিন মা বলে জানত, প্রভু আজ কেন তার মাতৃত্ব অপহরণ করলেন, কেন তাকে হৃদয়হীন শক্তি বলে ব্যাখ্যা করলেন?’ 

রঘুপতি তার অশুভ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। রাজ্যলাভের লোভ দেখিয়ে ভ্রাতার রক্ত প্রবহের জন্য উসকে দেওয়ার অশুভ প্রয়াস চালালেন। কিন্তু কোনো উচ্ছ্বাসই দেখা গেল না নক্ষত্ররায়ের মুখে। তিনি নির্লিপ্ত। ভ্রাতার রক্ত ঝরাবেন। রাজা হবেন। এ কথা তাকে চমকে দিল। রাজক্ষমতার প্রবল তৃষ্ণা থাকলেও রক্ত পিপাসা নেই তার মধ্যে। তখন রঘুপতি বললেন, মা রাজরক্ত দেখতে চান। স্বপ্নে তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। মহারাজার রক্ত এনে দিতে হবে। 

নক্ষত্ররায় চুপ। রঘুপতি আবারও উসকে দিলেন। হঠাৎ ভ্রাতৃস্নেহের উদয় হলো নাকি? 

রাজরক্ত প্রবাহে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলেও বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে এ কার্য সমাধা করার কথা বললেন নক্ষত্ররায়। রঘুপতির সেখানে অমত। কেবল পুষ্করই আপনার সাহায্যে নিযুক্ত হবে। ওকে মহামন্ত্রী করবেন। 

নক্ষত্ররায় প্রস্থান করতে পেরে হাপছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু পুষ্কর রাজি নয়। ভ্রাতাবধ ভয়ানক পাপ। সেই পাপে প্রভু রাজভ্রাতাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। রঘুপতি বললেন, ‘শোন বৎস, তোমাকে আরেক শিক্ষা দেই। পাপপূণ্য কিছুই নাই। কেই বা পিতা, কেই বা ভ্রাতা, কেই বা আপনজন? বধ করা যদি পাপ হতো তাহলে সকল বধই সমান...। 

পুষ্কর দেবীর উদ্দেশে বলল,‘ এ জন্যই কি তোকে সকলে মা বলে? তুই এমন পাষাণী রাক্ষসী! সমস্ত জগৎ থেকে রক্ত নিষ্পেষণ করে নিয়ে উদর ভর্তি করার জন্য তুই লাল জিহ্বা প্রসারিত করেছিস? প্রেম-মমতা-সৌন্দর্য সমস্তই মিথ্যা, সত্য কেবল তোর অনন্ত রক্ততৃঞ্ষা?

রঘুপতি বললেন, ‘গোবিন্দমাণ্যিকের প্রতি দেবী অসোন্তষ হয়েছে, অসোন্তষের সম্পূর্ণ কারণও জন্মেছে। অতএব দেবী যখন রাজরক্ত চাচ্ছেন তখন বুঝতে হবে, তা মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যেরই রক্ত।’

পুষ্কর বলল, আমি রাজরক্ত আনব। মায়ের নামে, প্রভুর নামে ভ্রাতৃবধ ঘটতে দেবেন না।

এখানেই লুকিয়ে রয়েছে রাজাবলি নাট্যোপন্যাসের আরেক রহস্য। কারণ পুষ্কর বুঝতে পেরেছিল দীর্ঘদিন যাকে সে প্রভু জেনে এসেছে, যে তাকে শৈশবে আশ্রয় দিয়ে লালন পালন করেছেন, তার অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। দেবী রক্ত চায়নি। এই রক্তের পিপাসা প্রভুর। তাহলে কেন সে রাজরক্ত আনতে রাজি হলো? নক্ষত্ররায়ের হাত থেকে মহারাজাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে এখানে। পুষ্কর গেল রাজরক্ত আনতে। সেখানে তাদের আলাপে তা ধরা পড়েছে। 

পুষ্কর: কেন মহারাজ, ধর্মশ্রাস্ত্রে তো জীববধ নিষিদ্ধ নয়!

গোবিন্দমাণিক্য: ধর্মশাস্ত্রের যথার্থ বিধি কেউ-বা পালন করে। নিজের প্রবৃত্তি অনুসারে সকলেই ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে থাকে। যখন দেবীর সম্মুখে জীবের রক্ত সর্বাঙ্গে মেখে মানুষ উৎকট চিৎকারে ভীষণ উল্লাসে নৃত্য করতে থাকে, তখন কী তারা ধর্মের জয়গান করে, না নিজের হৃদয়ের মধ্যে যে হিংস্র রাক্ষসটা আছে সেই রাক্ষসটারই পুজো করে? হিংসার কাছে জীববধ শাস্ত্রের বিধি নয়, হিংসাকে বলি দেওয়াই শাস্ত্রের বিধি। 

পুষ্কর: আমি স্বকর্ণে শুনেছি, এ বিষয়ে আর কোনো সংশয় নেই। দেবী সয়ং বলেছেন, তিনি রাজরক্ত চান। 

গোবিন্দমাণিক্য: এ তো দেবীর আদেশ নয়, বরং রঘুপতির আদেশ।

আবারও সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেল পুষ্কর। তবু রাজরক্ত নেয়ার জন্য সে ধৃষ্টতা দেখাল। চাপতি খাপ মুক্ত করল। তখনই দময়ন্তী চিৎকার করে এসে মহারাজকে আগলে ধরল। এখানে এসে কাহিনি অন্যদিকে মোড় নিয়ে আর একটি উপকাহিনি ঢুকে পড়ল। সে কাহিনিতে রয়েছে পুষ্কর আর দময়ন্তীর অন্তনিহিত প্রেম। তাই রাজরক্ত প্রবাহিত না করে চাপাতি ফেলে অভয় দিয়ে পুষ্কর বলল, ‘মহারাজকে সাবধান করে দিই, আপনার ভ্রাতা রাজকুমার নক্ষত্ররায় আপনার বিনাশের পরামর্শ করছেন। চতুর্দশ দেবতার পুজোর রাতে আপনি সতর্ক থাকবেন। ’

গোবিন্দমাণিক্য: কেউই আমাকে বধ করতে পারবে না। সবাই আমাকে ভালোবাসে।

পুষ্করের মনে তবু সন্দেহ রয়ে গেল। তার থেকেও বেশি স্থান করে নিল দময়ন্তী। শৈশব থেকে তারা একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। এখন নিজেদের জীবন এক তরবারির খাপে আবদ্ধ করতে চাচ্ছে। সেখানেও বাধা রঘুপতির। সত্যবতীর কাছে সে ইচ্ছের কথা পুষ্কর প্রকাশ করতেই রঘুপতির মোনভাব জানিয়ে দিলেন তিনি। প্রবল ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রভুর আদেশের ওপর শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল পুষ্কর। কিন্তু দময়ন্তী তা মানতে নারাজ। যেকোনো মূল্যে পুষ্করকে চায়। তার সেবাদাসী হয়েই জীবন পার করার ব্রত নিয়ে এক রাতে লোকচক্ষুর আড়ালে পুষ্করের চরণে নিজেকে সমর্পণ করল, স্থান চাইল। পুষ্কর প্রত্যাখ্যান না করলেও গ্রহণের জন্য উতালা হলো না। সে কেমন আহত মন নিয়ে দময়ন্তীর নিবেদন শুনে গেল। চরণে নয়, ঠাঁই দিয়েছে হৃদয়ে। কিন্তু প্রভুর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গ্রহণ করতে পারছে না।   

এই প্রত্যাখ্যান দময়ন্তীকে পুষ্করের বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড় করাল। তাখন সে জানতে পারল রঘুপতি তার পিতা। ভালোঘরে বিয়ে হচ্ছে জানিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইল পুষ্করকে। তবে সে স্বামী হিসেবে পুষ্করকেই লালন করছে মনের গহীন অরণ্যে। তা অকপটে স্বীকার করল মনোরমার কাছে।

মহারাজার মনে পুষ্করের ঢেলে দেওয়া সেই সন্দেহের বার্তা। ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছেন না। একান্তে বসে ভাবছেন, ‘ হায় হায় স্নেহের নীড়ের মধ্যেও হিংসা ঢুকে পড়েছে। সে সাপের মতো লুকাতে চাচ্ছে। মুখ দেখাতে চাচ্ছে না। আমাদের অরণ্যে কি হিংস্র পশু যথেষ্ট নেই, শেষে কি মানুষও মানুষকে ভয় করবে, ভ্রাতাও ভ্রাতার পাশে গিয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে বসতে পারবে না? এই সংসারে হিংসা লোভ এতই বড় হয়ে উঠল। আর স্নেহ-প্রেম কোথাও ঠাঁই পেল না। এই আমার ভ্রাতা! তার সঙ্গে প্রতিদিন এক গৃহে বাস করি, একই রাজসভায় বসি, হাসিমুখে কথা বলি; এও আমার পাশে বসে মনের মধ্যে ছুরি শাণাচ্ছে। 

এই স্নেহ-প্রেমহীন হানাহানির রাজ্যে বেঁচে থেকে আমি আমার স্বজাতির, আমার ভ্রাতাদের মনে কেবলই হিংসা লোভ ও দ্বেষের অনল জ্বালাচ্ছি। আমার সিংহাসনের চারপাশে আমার প্রাণিধিক আত্মীয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে মুখ বাঁকা করছে! শৃঙ্খলবদ্ধ শেয়ালের মতো চারদিক থেকে আমার উপরে ঝাঁপেিয় পড়ার অবসর খুঁজছে...।’

এক সন্ধ্যালগ্নে ভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে সঙ্গে নিয়ে পদব্রজে অরণ্যের দিকে গেলেন মহারাজ। এরপর জনমানবশূন্য এক স্থানে ভ্রাতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, নক্ষত্ররায়, তুমি আমাকে মারতে চাও? কেন মারবে ভ্রাতা? রাজ্যের লোভে? তুমি কি মনে করো মহারাজ কেবলই সিংহাসন, হীরার মুকুট ও রাজছত্র? এই মুকুট, এই রাজছত্র, এই রাজদণ্ডের ভার কত তা জান? শতসহস্র লোকের চিন্তা এই হীরের মুকুটে ঢেকে রেখেছি। রাজ্য পেতে চাও তো সহস্র লোকের বিপদকে আপনার বিপদ বলে বরণ কর, সহস্য লোকের দারিদ্যকে আপনার দারিদ্র বলে স্কন্ধে বহন কর, এ যে করে সেই রাজা, মহারাজা, সে জির্ণ-কুটিরেই থাক আর রাজপ্রাসাদেই থাক। যে ব্যক্তি সকল লোককে আপনার বলে মনে করতে পারে সকল লোক তো তারই। পৃথিবীর দুঃখহরণ যে করে সেই পৃথিবীর রাজা, মহারাজা। পৃথিবীর রক্ত ও অর্থ শোষণ যে করে সে তো দস্যু; সহস্য অভাগার অশ্রুজল তার মস্ককে অহর্নিশ বর্ষিত হচ্ছে, সেই অভিশাপ থেকে কোনো রাজচ্ছত্র তাকে রক্ষা করতে পারে না। তার প্রচুর রাজভোগের মধ্যে শত শত উপবাসীর ক্ষুধা লুকিয়ে আছে, অনাথের দারিদ্র্য গলিয়ে যে স্বর্ণলাংকার তৈরি করতে পারে, তার ভূমিবিস্তৃত রাজবস্ত্রের মধ্যে শত শত শীতাতুরের মলিন ছিন্ন স্থান পায়। রাজাবধ করে রাজত্ব মেলে না ভ্রাতা, পৃথিবীকে বশ করে রাজা হতে হয়।’

নক্ষত্ররায়কে রাজা ও রাজ্যের এই সংজ্ঞা দিয়ে তার হাতে তরবারি তুলে দিলেন মহারাজা। বললেন, ভ্রাতার বুকে এখানে তরবারি বসাও। কেউ তোমাকে নিবারণ করবে না।  

তরবারি নক্ষত্ররায়ের হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ভ্রাতার রক্ত প্রবাহ করার মতো পাপ কখনো তার মনে উদয় হয়নি। এসব যে রঘুপতির ষড়যন্ত্র তা প্রকাশ করে দিলেন। 

ভ্রাতার হাত ধরে মাহারাজা গেলেন মন্দিরে। রঘুপতিকে প্রণাম করলেন। রঘুপতি বুঝতে পারলেন নক্ষত্ররায়কে দিয়ে রাজরক্ত আনতে পারবেন না। তবু তিনি সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন না। নতুন ষড়যন্ত্র করলেন। ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন প্রজা সাধারণ। বললেন দেবী রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে। মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যকে রাজ্য ছাড়া না হওয়া পর্যন্ত ফিরবেন না।

 সেখানেও সফল হলেন না। প্রজাগণ এই রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাইল না। কেননা এমন রাজা অন্যায় করতে পারেন না। পুষ্করও মন্দির আর রঘুপতিকে ছেড়ে রাজার কাছে আশ্রয় নিল। কেননা সে দেবীকে মা বলে জেনে এসেছে। রঘুপতি তাকে বলছেন শক্তি। সে এখন হিংসায় মেতে উঠেছে। রক্ত চায়। সে রাজরক্তের লালসায় তৃষিত। এটা পুষ্কর মানতে পারল না। কিন্তু তার জীবনের প্রভুর অনেক ঋণ। তাই ফেলেও যেতে পারে না। আবার ফিরে আসে। রঘুপতি রাজরক্ত আনতে তাকে নির্দেশ দিলেন। চতুর্দশ পুজোর রাতে সে রক্ত চাই। রাজরক্ত আনতে গিয়ে পুষ্কর রাজার কাছ থেকে বিদায় নিল রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। রঘুপতি অপেক্ষা করছেন পুষ্করের ফেরার। কখন আসবে রাজরক্ত নিয়ে। পুজো শুরু করবেন। অবশেষে পুষ্কর ফিরলেন।

রঘুপতি: রাজরক্ত এনেছ?

 পুষ্কর: এনেছি। রাজরক্ত এনেছি। আপনি সামনে বসুন। আমি দেবীকে নিবেদন করব। সত্যই কি তবে তুই রাজরক্ত চাস, রাজরক্ত না হলে তোর তৃষ্ণা মিটবে না? জন্মাবধি আমি তোকেই মা বলে ডেকে এসেছি, তোরই সেবা করেছি, আর কারও দিকে তাকাইনি, আমার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমি রাজপুত, আমি ক্ষত্রিয়। আমার কাকাও রাজপুত। তার প্রপিতামহ রাজা ছিলেন। তার মাতামহবংশীয়রা রাজত্ব করেছেন। এ নে তাহলে রাজরক্ত, এখন তোর তৃষ্ণা মিটা।’ 

এরপর রঘুপতির হৃদয়ে বসিয়ে দিল ছুরি। প্রবাহিত হলো রাজরক্ত। রাজাবলি শেষ হয়েছে অনেকটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে। রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। পুষ্কর কেন রাজরক্ত আনতে গিয়ে মহারাজাকে হত্যা না করে ফিরে এলো? যে প্রভু তাকে লালন করল, মার্যাদার জায়গা তুলে দিল, যে রাজরক্ত আনতে পাঠাল, তার রক্তই বা কেন দবীর সামনে প্রবাহিত করল? তাহলে পুষ্কর বুঝতে পেরেছিল যে মাহারাজার পথই সঠিক? নাকি ধরতে পেরেছিল রঘুপতির দুরভিসন্ধি? না সে যে দেবীকে মা বলে জেনে এসেছে সে হিংসায় মাতেনি। রক্ত চায় না। না পুষ্কর তার প্রেমকে অমর করতেই রঘুপতিকে সরিয়ে দিল, যাতে দময়ন্তীকে পেতে আর কোনো বাধা না থাকে।        

 ৩

রাজাবলি নাট্যোপন্যাসটি রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে স্বার্থক। কেননা ইতিহাসের এ ধারা চলমান। এখানে মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যর জীবন বিনাশ হয়নি। তবে সব আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু পুষ্করের সততা কিংবা মহারাজার প্রতি নিস্বার্থ প্রেমের কারণে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে যত রাজহত্যা হয়েছে তাদের পেছনে কোনো এক নক্ষত্ররায়, নাহয় রঘুপতি রয়েছেন। সে হত্যার জন্য কখনো তারা ধর্মেরও আশ্রয় নিয়েছেন। নিছক স্বার্থ কিংবা মত প্রতিষ্ঠার জন্য। ধর্মকে উচ্চকিত করার প্রয়াসে নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নবাব সিরাজ হত্যার পেছনেও কোনো এক রঘুপতি ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড একই সাক্ষ্য দেয়। এই হত্যকাণ্ডের পেছনেও রজক্ষমতা লোভী কোনো নক্ষত্ররায় ও রঘুপতি ছিল। এ কারণেই রাজাবলি নাট্যোপন্যাসটি সময়কে অতিক্রম করে মহাকালকে ধারণ করেছে। 

৪উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণে লেখক অত্যান্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্রের মুখে সংলাপ তুলে দিয়েছেন দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে এক শক্তিশালী স্রষ্টার আসনে বসে। মনে হয়নি কোনো কথাই আরোপিত। কিংবা চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। জোর করে মুখে জুড়ে দিয়েছেন। মহারাজার ভাবনা কিংবা তার সংলাপে প্রজ্ঞা রয়েছে। রাজ্য চিন্তা রয়েছে। ভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে একান্তে রাজ্য পরিচলানার যে দায়িত্বের কথা বললেন তা অনন্য। কোনো সাধারণ কথা নয়। আবার রঘুপতির মুখে যে সংলাপ বা মনোস্তাত্বিক চিন্তার প্রবেশ ঘটিয়েছেন তা বাস্তবের থেকে কম নয়। মনে হবে না নাটকের সংলাপ। রচনা শৈলিতে রয়েছে জাদুর কাঁটা। যা পাঠককে আকড়ে ধরবে। 

লেখক শব্দ চয়নে, বাক্যগঠনে, উপমা ও দৃশ্য চিত্রায়নে বিচিত্র স্বভাব আবিষ্কার করেছেন। করেছেন ব্যাপক নবীকরণ, গভীর অনুসন্ধিৎসায়, দর্শনের নব দিগন্তের ছোঁয়ায় সমুজ্জ্বল এবং আঙ্গিকের স্বতন্ত্র সৃষ্টির বিস্তার ঘটিয়েছেন। গল্প বলার মধ্যে রয়েছে দারুণ দক্ষতা, সেই সঙ্গে তৈরি করছেন সাতন্ত্র পথ। যা একান্ত তাকে-ই তুলে ধরবে। বর্ণনার বৈচিত্র্যতার সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে যে জীবনবোধ, প্রেম, কাম, লোভ, দন্ধ, সততা, স্বার্থপরতা, ক্রোধ, হিংসা তুলে ধরেছেন তা মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের সংলাপের মতো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হওয়ার কথা। যদি গ্রন্থটি ব্যাপক পঠিত হয় আমার বিশ্বাস এই সংলাপগুলো একদিন মানুষের মুখে স্থান পাবে। আর সেটাই হবে মুকিদ চৌধুরীর এই রচনার স্বার্থকতা।  

রাজাবলি প্রকাশ করেছে: দেশ পাবলিকেশন্স

প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর

মূল্য: ১৫০ টাকা