সাহিত্যে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার

আলমগীর মোহাম্মদ
২১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯
শেয়ার :
সাহিত্যে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার

ইতিহাসের পাতায় যখনই একনায়কতন্ত্রের অন্ধকার নেমে এসেছে, সাহিত্য তখনই প্রতিরোধের মশাল হাতে দাঁড়িয়েছে। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের শাসনকাল, ক্ষমতার উন্মত্ততা এবং এর ফলে সৃষ্ট মানুষের দুর্ভোগকে উপজীব্য করে রচিত সাহিত্য বিশ্বজুড়ে এক শক্তিশালী ও অপরিহার্য ধারা। এই রচনাগুলো কেবল সময়ের দলিল নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মানব চেতনার এক শাশ্বত প্রতিবাদ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রচিত এসব সাহিত্যকর্ম প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যত তীব্রই হোক না কেন, মানুষের স্বাধীনতা, সত্যের প্রতি আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ এবং গল্প বলার ক্ষমতা কখনই পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না।

বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে সর্বাত্মকবাদী (Totalitarian) রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান, বিশেষ করে স্ট্যালিনবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্যাসিবাদী জার্মানির ভয়াবহতা সাহিত্যিকদের গভীরভাবে নাড়া দেয়। এরই প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয় ‘ডিস্টোপিয়ান ফিকশন’। এটি এমন এক সাহিত্যধারা, যা কাল্পনিক সর্বাত্মকবাদী সমাজের চিত্র এঁকে বাস্তবে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে চলা বিপদের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করে। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ (Nineteen Eighty-Four) এই ধারার অন্যতম উদাহরণ। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত এই বইটি ‘বিগ ব্রাদার’ নামে এক কাল্পনিক কিন্তু সর্বব্যাপী স্বৈরশাসকের অধীনে ‘ওশেনিয়া’ নামক রাষ্ট্রের জীবনব্যবস্থা তুলে ধরে। অরওয়েল দেখিয়েছেন, কীভাবে সরকার ‘চিন্তা পুলিশ’ (Thought Police), অবিরাম নজরদারি (Telescreens) এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির (Ministry of Truth) মাধ্যমে জনগণের ব্যক্তিগত জীবন ও চিন্তাভাবনা (Thought crime) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। এই উপন্যাসটি স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হিটলারের জার্মানির মতো বাস্তব স্বৈরশাসনগুলোর ওপর এক ভয়াবহ ভাষ্য, যা রাষ্ট্রীয় প্রচার, তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভাষার অপব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে জনগণের ওপর চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তার করে, তা ফুটিয়ে তোলে।

অন্যদিকে অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্ম’ (Animal Farm) ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক তীক্ষè রূপকধর্মী (Allegorical) উপন্যাস এটি। একদল পশুর খামার দখলের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা হলেও শেষ পর্যন্ত শূকর নেপোলিয়ন (স্ট্যালিনের প্রতীক) এবং তার অনুগামীরা কীভাবে সেই বিপ্লবী নীতিগুলোকে নিজেদের স্বার্থে বিকৃত করে একটি নতুন, আরও নৃশংস একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, তারই বর্ণনা এতে রয়েছে। এই উপন্যাসের একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘All animals are equal, but some animals are more equal than others’, স্বৈরতন্ত্রের জন্ম ও বিবর্তনকে সংজ্ঞায়িত করেছে।

নিয়ন্ত্রণ ও বৈজ্ঞানিক স্বৈরতন্ত্রের দিক থেকে আল্ডুস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (Brave New World) একটি ক্লাসিক। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত এই ডিস্টোপিয়ান ক্লাসিকটি ভবিষ্যতের এমন এক সমাজকে চিত্রিত করে, যেখানে স্বৈরাচারী শাসন বলপ্রয়োগের চেয়েও সূক্ষ্ম উপায়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার জন্মগতভাবে শ্রেণিবিভাগ (Alphas, Betas, etc.), শর্তাধীন প্রশিক্ষণ এবং আনন্দের ওষুধ ‘সোমা’ (Soma) সরবরাহের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতা ও আবেগ দমন করে। এটি দেখায় যে, মানুষ যদি নিজেরাই স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখের বিনিময়ে নিজেদের স্বাধীনতা ত্যাগ করে, তবে সেই স্বৈরশাসন কতটা স্থায়ী হতে পারে।

এছাড়া ১৯২৪ সালে প্রকাশিত রুশ লেখক ইয়েভগেনি জামিয়াতিনের ‘আমরা’ (We) উপন্যাসটি ছিল অরওয়েল ও হাক্সলির ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের প্রধান অনুপ্রেরণা। এটি ‘বেনিফ্যাক্টর’ নামক একজন স্বৈরশাসকের অধীনে ‘একক রাষ্ট্র’ (One State) নামক এক সমাজকে তুলে ধরে, যেখানে জীবনকে গণিত ও যুক্তি দ্বারা চরমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ব্যক্তির নাম নেই, কেবল সংখ্যা এবং প্রতিটি পদক্ষেপ রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকে।

লাতিন আমেরিকার ইতিহাস সামরিক অভ্যুত্থান এবং দীর্ঘজীবী স্বৈরশাসকদের দ্বারা চিহ্নিত। এখানকার লেখকরা এই শাসক এবং তাদের শাসনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এক বিশেষ সাহিত্যধারা সৃষ্টি করেন, যা ‘ডিক্টেটর নভেল’ (The Dictator Novel) নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এ উপন্যাসগুলো প্রায়ই বাস্তব স্বৈরশাসকদের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে রচিত, তবে তা কাল্পনিক ও প্রতীকী ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়। নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘পতন’ (The Autumn of the Patriarch) এই ধারার চূড়ান্ত উদাহরণ। এটি একজন নামহীন ক্যারিবীয় একনায়কের প্রায় একশ বছরের জীবন ও শাসনকালকে চিত্রিত করে। উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু হলো- ক্ষমতার চূড়ায় থাকা স্বৈরশাসকের চরম নিঃসঙ্গতা। এই শাসক জনগণের চোখে প্রায় অমর হয়ে ওঠেন, কিন্তু ক্ষমতা রক্ষায় তার নির্দয়তা ও পাগলামির মধ্যে তিনি একাই বন্দি। মার্কেজ অত্যন্ত কাব্যিক ও দীর্ঘ বাক্যের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিভীষিকা এবং এর অনিবার্য পতনের চিত্র এঁকেছেন। তার অন্য কাজ ‘একশ বছরের নিঃসঙ্গতা’ (Cien a-os de soledad) সরাসরি ডিক্টেটর নভেল না হলেও এর কাল্পনিক শহর ‘মাকান্দো’ এবং বুয়েন্দিয়া পরিবারের জীবন লাতিন আমেরিকার সামরিক স্বৈরতন্ত্র, গৃহযুদ্ধ ও নিপীড়নের চক্রাকার ইতিহাসের প্রতীকী চিত্রায়ণ করে।

নোবেলজয়ী পেরুভীয় লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসার ‘ছাগল উৎসব’ (The Feast of the Goat) উপন্যাসটি ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রের কুখ্যাত স্বৈরশাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর (Rafael Trujillo) হত্যাকাণ্ড এবং তার দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী শাসনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে রচিত। ইয়োসা দেখিয়েছেন, কীভাবে একজন স্বৈরশাসক কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রই নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, নৈতিকতা ও পরিবারের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। এই উপন্যাসটি ট্রুজিলোর শাসনকে ঘিরে থাকা ভয়, ষড়যন্ত্র এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তির আকাক্সক্ষার এক ঐতিহাসিক দলিল।

কিউবার লেখক আলেহো কারপেন্তিয়েরের রিজনজ অভ স্টেইট (Reasons of State) উপন্যাসটি লাতিন আমেরিকার এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্বৈরশাসকের জীবনকে কেন্দ্র করে লেখা, যিনি ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট এবং একজন ফরাসি ধাঁচের একনায়কের প্রতীক। কারপেন্তিয়ের দেখিয়েছেন যে, স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদেশে পালিয়ে গেলেও তার ক্ষমতা, অহংকার এবং রাজনৈতিক প্রভাব কীভাবে তাকে তাড়া করে ফেরে।

স্বৈরাচারী শাসন লাতিন আমেরিকা বা সোভিয়েত বলয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বিশ্বজুড়েই লেখকরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। আলবেনীয় লেখক ইসমাইল কাদারে তার সাহিত্যকর্মে তার দেশের কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক এনভার হোজার ভয়াবহ শাসনের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। তার উপন্যাস ‘স্বপ্ন প্রাসাদ’ (The Palace of Dreams) একটি কাল্পনিক কিন্তু সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণকারী এক আমলাতান্ত্রিক সংস্থার মাধ্যমে হোজা শাসনের নজরদারি ও বিভীষিকার চিত্র তুলে ধরে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাহিত্যকে এক শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

অন্যদিকে আমেরিকান লেখক সিনক্লেয়ার লুইসের ‘এখানে এটি ঘটতে পারে না’ (It CanÕt Happen Here) ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি দেখায়, কীভাবে একজন ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা দখল করতে পারে। এটি আমেরিকান গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতা এবং ফ্যাসিবাদী প্রচারণার উত্থানের বিষয়ে এক আগাম সতর্কতা। ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা সাহিত্যকর্মগুলোও স্বৈরাচারী শাসনের মনোবিজ্ঞান বুঝতে সাহায্য করে। রবার্ট গ্রেভসের ‘আই, ক্লডিয়াস’ (I, Claudius) রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটদের স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক ক্লাসিক চিত্রায়ণ। সম্রাট ক্যালিগুলা, নিরো বা টিবেরিয়াসের কাহিনিতে স্বৈরশাসকদের মানসিক অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত নির্দয়তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানকে কেন্দ্র করে রচিত এই আন্তর্জাতিক সাহিত্যধারা মানবজাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়কে আলোকিত করে। জর্জ অরওয়েলের সতর্কবার্তা, মার্কেজের কাব্যিক নিঃসঙ্গতা, ইয়োসার ঐতিহাসিক গভীরতা এবং কাদারের সূক্ষ্ম প্রতিবাদ- প্রতিটি রচনাই স্বৈরতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো উন্মোচন করে: ভয়, অসত্য প্রচার, ব্যক্তির বিলুপ্তি এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দুর্নীতি। এই সাহিত্যকর্মগুলো শুধু স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, বরং মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড ও মুক্তির আকাক্সক্ষার এক নিরন্তর স্মারক। এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যে কোনো সময়, যে কোনো দেশে স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে সাহিত্যকে সচেতনতার এক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা অপরিহার্য। া