এ অচলায়তন ভাঙতে অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য
আমার দুই সন্তান- সক্রেটিস, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে এবং সব্যসাচী, আইয়ে পড়ছে। গত পনেরো মাসে আমার কাছে প্রায় প্রতিদিন নানা প্রশ্ন করেছে। তাদের প্রশ্নের বিষয়বস্তু আসে ফেসবুক, সংবাদপত্র ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও সংঘর্ষের খবর নিয়ে। সক্রেটিস সহজ ভাষায় জানতে চায়, ‘বাবা, মানুষ এত খারাপ কেন? আজ একজনকে পিটিয়েছে, আজ একজনকে গুলি করেছে, আজ আবার কারও বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সরকার কী করছে?’ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়াটা সহজ নয়। কখনও আমি উত্তর দিই, কখনও নীরব থাকি। তবে এই প্রশ্ন আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়- রাষ্ট্র ও সমাজের বাস্তবতা শুধু নয়, এটি শিশুদেরও যন্ত্রণা দেয়।
আমি দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে ঢাকায় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গন, শহীদ মিনার, শাহবাগ ও প্রেসক্লাবে হাজারবার মিছিল-মিটিং-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছি। এসব মঞ্চ থেকে বারবার বলা হয়েছে- শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম দিতে হবে, মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া চলবে না। বিরোধী দলের ওপর মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। হত্যা, ধর্ষণ ও গুম বন্ধ করতে হবে। গরিব মেহনতি মানুষের জন্য রেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান করতে হবে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, লুটপাট থামাতে হবে, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, সন্ত্রাস দমন করতে হবে, টেন্ডারবাজি ও দখলদারিত্ব রোধ করতে হবে। সিপিবি-বামজোট এসব বারবার বলেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কেউ বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
আজও রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র নির্দেশ করছে- পরিবর্তন হয়নি। বরং হত্যাকাণ্ড, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধীরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দলের ওপর সহিংসতা, গুম, দমন-পীড়ন অব্যাহত। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চরিত্রে পরিবর্তন হয়নি; কেবল বাহ্যিক রূপ পালটেছে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার অবস্থা ভয়াবহ। ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত হয়নি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নেই, দীর্ঘ সময় কাজ করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীবন বিপন্ন। কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী মধ্যস্বত্বভোগী ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনের কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাচ্ছে।
অর্থনীতির পরিস্থিতি ভয়াবহ। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, খাদ্য ও জ¦ালানির দাম আকাশছোঁয়া। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ কঠিন। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট এবং বিদেশে টাকা পাচার রাষ্ট্রের আর্থিক স্থিতিশীলতা কমিয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তায় প্রায় অব্যবস্থা।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অবস্থা অনিশ্চিত। সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অবকাঠামো দুর্বল। ওষুধের অভাব, দীর্ঘ অপেক্ষা। স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। শিক্ষাক্ষেত্রেও অবকাঠামো, শিক্ষক দক্ষতা ও সুযোগ সীমিত। গ্রামীণ শিশু ও যুবক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বৈষম্য স্পষ্ট। নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা, বৈষম্য এবং নির্যাতন বেড়েছে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, লিঙ্গ বৈষম্য, ঘৃণার রাজনীতি অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। কিশোর গ্যাং, সন্ত্রাস, মাদক এবং অপরাধের বিস্তার- সবই রাষ্ট্রের দুর্বলতার ফল। অপরাধীরা দমনহীন, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অদক্ষতা ও সরকারের দুর্বলতার কারণে দমন করা সম্ভব হয়নি।
মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও লক্ষণীয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি- ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ মানবিক নৈতিকতা, সম্পর্ক ও সহানুভূতির গভীর মান প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথের ভাবমতে সম্পর্ক হলো মানবিক অস্তিত্বের ভিত্তি। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সৌন্দর্য মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সংযোগ ও নৈতিকতার ওপর নির্ভরশীল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। তখন স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দারিদ্র্য, খাদ্য-অসুবিধা, মজুর, শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার লঙ্ঘন- সবই এখনও চলমান।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ছিল স্বৈরাচার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। কিন্তু পাঁচ আগস্টের পর শুরু হওয়া হামলা, গুম, নির্যাতন ও দমন-পীড়ন ন্যায্যতা ও শান্তির স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজ গ্রেপ্তার হয়নি, পাচারকৃত টাকা ফেরত আসেনি। মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্য, বেকারত্ব বেড়েই চলেছে।
অপরাধীরা হঠাৎ কোথাও জন্মায় না; তারা গড়ে ওঠে বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা এবং ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে। দুর্বল শাসন, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং প্রশাসনিক পক্ষপাত অপরাধীদের উৎসাহ দেয়। বর্তমান অস্থিরতা ও হতাশার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংস্কার হলো নিজেকে প্রশ্ন করা- ‘আমি কি নিজেকে পরিবর্তন করেছি’? সংস্কার ছাড়া সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। আপনি যদি সমাজকে পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আগে নিজেকে পরিবর্তন করুন। কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানুষের চিন্তা ও চেতনার রূপান্তর। কেবল আইনকানুন, অবকাঠামো বা প্রযুক্তি পরিবর্তন করলেই সমাজ বদলায় না, যদি মানুষের মানসিকতা পুরনো বিশ্বাস আর সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থাকে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণ ভেবেছিল- শেখ হাসিনা চলে গেলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা বিপরীত; পুলিশ, র্যাব ও আনসারের পোশাক বদলেছে, চরিত্র বদলায়নি। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার শুধুই ব্যক্তি বা দালানকোঠায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রবাহিত। তাই শক্তি প্রয়োগ দিয়ে এটি প্রতিরোধ করা যথেষ্ট নয়। সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক পন্থায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রচর্চার মাধ্যমে প্রতিরোধের সংস্কার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বলে সাধারণত সম্মতি রয়েছে। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে দেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করেছিলেন। তার সরকারের নীতিতে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক ভিন্নমত স্বীকার এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হ্রাস করাই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল।
বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তারেক রহমান অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র ও রাজনীতির ধারণার মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের রূপরেখা ৩১ দফা ও ভিশন-২০৩০ এ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে সময়ই বলে দেবে এই রূপান্তরের বার্তা কতটা কার্যকর হবে। গণতন্ত্র তখনই সফল হবে, যখন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্র হবে সবার মৌলিক অধিকারের রক্ষক ও জনতার প্রকৃত সেবক।
শেখ রফিক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব