‘যতই আড়ালে রাখো...’
‘গুপ্ত রাজনীতি’ আর ‘সুপ্ত প্রতিভা’ সম্প্রতি নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনার ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবে দেখেছেন কেন এই গোপনীয়তা, কেন এই লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প? রাজনীতির বাইরে গেলে খেয়াল করবেন সামাজিক মাধ্যমে বেশির ভাগ নারী সেলিব্রেটিও তার স্বামী কিংবা প্রেমিকের ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তুমুল গোপনীয়তা বজায় রাখছেন। আপনারা বাংলাদেশের সেলিব্রেটিদের কথাই ধরেন। টর্চলাইট কিংবা হারিকেন হাতে নিয়ে তাদের প্রোফাইল থেকে ঘুরে এলেও তন্নতন্ন করে খুঁজে তাদের পুরুষসঙ্গীর ছবি পাবেন না।
শুরুতে তেলেগু অভিনেত্রীদের কথা ধরা যাক। এই লেখার শুরুতে আমি নাম ধরে কয়েকজন সেলিব্রেটির ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল চেক করেছি। কাজল অগরওয়াল, শ্রুতি হাসান, নয়নতারা, তামান্না ভাটিয়া, নিত্যা মেনন, সামান্তা রুথ প্রভু, রাশ্মিকা মন্দানা, রাশি খান্না, হংসিকা মতোয়ানি, ইলিয়ানা ডি ক্রুজ, পূজা হেগড়ে, কীর্তি সুরেশ, তৃষা কৃষ্ণাণ, পুনম বাজওয়া, সোনম বাজওয়া, অনুষ্কা শেট্টি, নিহা শর্মা, নিধি অগরওয়াল কিংবা সোনাল চৌহানের ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রাম খুঁজে তাদের ছেলেসঙ্গীদের কোনো ছবি আপনারা পাবেন না বললেই চলে। আর দু-একটা পেলেও সেটা হাতেগোনা।
কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগেই সেলিব্রেটিদের জীবনের প্রতিটি অংশই ছিল বিনোদনের অংশ। তাদের বিয়ে, জন্মদিন, সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে প্রতিটি অংশ কাভার করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন বিনোদন সাংবাদিকরা। ওদিকে তারাও চেষ্টা করতেন প্রতিটি ঘটন-অঘটন শোবিজের সাংবাদিকদের সামনে তুলে দিয়ে খবরের শীর্ষে থাকতে। সম্প্রতি বদলে গেছে এই পরিস্থিতি। তারা চাইলে যে কোনো মুহূর্তে ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রামে একটা ছবি পোস্ট করলে সেটাই খবর হয়ে যায়। তারপরও তারা কেন যেন আড়াল করতে চাইছেন নিজেদের একান্ত মুহূর্তগুলোকে, নিজেদের সুন্দর সময় আর উপভোগ্য অনুভূতির অংশীজনকে।
তবে এখনকার হিসেবে সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রতিটি মুহূর্ত ভাগাভাগি করা, নিজেদের সাফল্য প্রদর্শন করা কিংবা ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো শেয়ার করা যেন এক ধরনের সুশোভিত পরিচয়ের অংশ। তবে এই পরিচয়ের আড়ালে নতুন ধরনের এই প্রবণতা অনেকে সামাজিক বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা বুঝতে চেষ্টা করছেন ‘নারীরা নিজেদের পুরুষসঙ্গীকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করে রাখছেন কেন?।
খেয়াল করলে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে এই নতুন রীতি সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ নারী ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের সেলফি, ফ্যাশন ব্লগ, ট্রাভেল ডায়েরি আর সাফল্যের গল্প শেয়ার করছেন দেদার। তারা একক ছবি দিয়ে প্রোফাইল ভরে ফেলছেন। কিন্তু তাদের এই ছবি তুলে দিচ্ছে কে? কার সঙ্গে তারা বেড়াচ্ছেন, ঘুরছেন-খাচ্ছেন সেই সঙ্গীকে কখনই স্পষ্টভাবে সামনে আনেন না। অনেকের ছবি, ভিডিও কিংবা পোস্টে সঙ্গীর উপস্থিতি থাকলেও তার মুখ, চেহারা বা পরিচয় প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে।
অনেক ইনফ্লু¬য়েন্সার কিংবা সেলিব্রেটি কখনও শুধু হাত, কখনও মুখের অর্ধেক অংশ, কখনও নিজেদের ছায়া কিংবা পেছন ফিরে থাকা ছবি এগুলো প্রকাশ করছেন। তবে এই কাজ তাদের পক্ষ থেকে সমাজের জন্য এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ? নাকি তারা নিজেদের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট লুকাতে চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি বিবিসি ওয়ার্ল্ড একটি সংবাদ করেছে, ‘ডড়সবহ ধৎব যরফরহম Women are 'hiding their boyfriends online and there's more than one reason why’ শিরোনামে।
তারা সেখানে তুলে ধরেছে তাওয়ানা মুসভাবুরি নামের এক তরুণী টিকটক ইনফ্লুয়েন্সারের গল্প। সে এই ঘটনার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তার হাজার হাজার ফলোয়ার জানে তার জীবনযাত্রার প্রতিটি দিক। কিন্তু তার প্রেমিকের চেহারা কেউ কখনও দেখেনি। আর সে এজন্য বলেছে, ‘আমি চাই না কেউ মনে করুক যে, আমার সাফল্যের পেছনে কোনো পুরুষের অবদান রয়েছে।’ বিবিসির হিসাবে এই মনোভাব শুধু একাধিক ইনফ্লুয়েন্সারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সাধারণ নারীরাও সামাজিক মাধ্যমে তাদের সঙ্গীকে আড়াল করতে ইচ্ছুক। তবে এর পেছনে যে গূঢ় কারণ রয়েছে, তা শুধু ব্যক্তিগত অনুরাগের কিংবা পরিসংখ্যানের খেলা নয়, বরং এটি নারীদের নতুন প্রজন্মের আত্মপ্রকাশের একটি প্রতীকী অবস্থা।
তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী ভোগ তার একটি প্রবন্ধে অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরেছে। তারাও দাবি করছে, ‘প্রেমিক বা পুরুষসঙ্গী থাকা আজকাল অনেকের জন্য বিব্রতকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পর্ক প্রদর্শন এখন ‘ক্রিঞ্জ’ বা ‘লুজার কালচার’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। নারীরা নিজেদের স্বতন্ত্রতা এবং শক্তির প্রকাশ করতে চাইছে এর মধ্য দিয়ে। তারা চাচ্ছে নিজের পরিচয়ে অন্যের বিচারের কোনো জায়গা না থাকুক। পাশাপাশি অনেকের হিসাবে এখানে নারীরা তাদের সম্পর্ক বদলের অপশন মাথায় রেখেই এগুলো করছেন। কারণ সেলিব্রেটিদের কেউ চাইবেন না একাধিক জনের সঙ্গে তাদের একান্ত মুহূর্তের ছবিগুলো সবার কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে ঘুরে বেড়াক আর মানুষ তাদের নিয়ে ঠাট্টা করুক।
তবে অনেকের জন্য এই প্রবণতার আরেকটি কারণ সামাজিক চাপের ভীতি। অনেক অভিনেত্রীর বাগদান কিংবা সম্পর্কের ছবি পোস্ট করার পর তার ফলোয়ার সংখ্যা হুড়মুড় করে কমে যায় বা তাদের অস্বস্তির সম্মুখীন হতে হয়। আর সেই পরিস্থিতি দেখেই অনেকে সহজেই সিদ্ধান্ত নেন, তারা আর সঙ্গীর ছবি প্রকাশ করবেন না। বিবিসির প্রতিবেদনে স্টেফানি ইয়েবোয়া নামের এক কনটেন্ট ক্রিয়েটর বলেছেন, ‘তার প্রেমিকের সঙ্গে ছবি প্রকাশ করার পর হাজারখানেক ফলোয়ার হারিয়ে ফেলেছেন। তার মতে, মানুষ প্রেম-ভরা কনটেন্ট দেখলেই অস্বস্তি অনুভব করে। আজকের ইনফ্লুয়েন্সারদের কাছে তার ব্র্যান্ড ইমেজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর থেকে সেটা অনুমান করে নেওয়া যাচ্ছে।
বেশির ভাগ ইনফ্লুয়েন্সারের কনটেন্ট মূলত স্টাইল, আইকনিক প্রেজেন্স এবং প্রেজেন্টেশন সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট নান্দনিকতা বিক্রি করে। আর সেখানে তার স্বামী কিংবা প্রেমিককে সামনে আনলে তার ব্র্যান্ড নষ্ট হতে পারে। কেউ কেউ ‘ইভিল আই’ তথা হিংসুটিদের কুদৃষ্টির ভয়ও পান। আর তাই বদনজর থেকে বাঁচতেও সম্পর্কের ছবি পোস্ট করতে চান না। তবে মনোবিজ্ঞানী গেন্ডোলিন সাইডম্যান বলেন, ‘ডিলিট করলেও অনলাইন কনটেন্ট আসলে মুছে যায় না।’ তাই নারীরা আজকাল নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গোপন রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। তারা জানেন, একবার যদি সম্পর্কের ছবি অনলাইনে চলে যায়, তা বহুদিন ধরে রয়ে যাবে, অপ্রত্যাশিত ফলাফল ডেকে আনতে পারে।
বিনোদন থেকে রাজনীতির ময়দানে আসা যাক। অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দেখা যায় কোনোভাবেই নিজের দলের নাম প্রকাশ করতে চান না। যে নিজে যেই রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করে কেউ তার পরিচয় প্রকাশ করলে সেটাকে তারা অভিহিত করতে চায় ‘ট্যাগসন্ত্রাস’ হিসেবে। অথচ আত্মপরিচয় একটা গৌরবের বিষয়। এই গৌরবের বিষয়কে গোপন করে তারা আসলে কী প্রমাণ করতে চায়? অনলাইন দুনিয়ায় সেলিব্রেটিরা যতই নিজেদের সঙ্গীকে আড়াল করতে চান সেটা আর আড়াল থাকে না।
একইভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ও লুকিয়ে রাখা যায় না। ডায়াপারের মধ্যে শিশুরা যখন মলত্যাগ করে বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও সেখানকার দুর্গন্ধকে যেমন চেপে রাখা যায় না, তেমনি সামাজিক মাধ্যমের অনলাইন ফুটপ্রিন্ট হিসাব করলে রাজনৈতিক পরিচয়ও গোপন রাখা যায় না। আর এর ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা ও গভীর রাজনৈতিক সংকট। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এর মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়তে পারে।
যারা পরিচয় আড়াল করে, তাদের বিপদটাও কম নয়। তারা নিজ পরিচয়ে পরিচিত নয় বলে তাদের যে যেমন খুশি, তেমন পরিচয় দেয়। ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাস ঘনীভূত হওয়ার বাইরে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। আর মনে মনে সবাই আইয়ুব বাচ্চুর সেই গানটার কথাই ভাবতে থাকে- ‘সুখেরই পৃথিবী/সুখেরই অভিনয়/যত আড়াল রাখো/আসলে কেউ সুখী নয়।’
ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : গবেষক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর; সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মতামত লেখকের নিজস্ব