উচ্চশিক্ষা বিস্তারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিধি গত তিন দশকে যে ব্যাপকতা অর্জন করেছে, তার অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমিত আসন এবং অবকাঠামোগত সংকটের কারণে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষা এক সময় ছিল অধরা। সেই শূন্যস্থান পূরণে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় যাত্রা শুরু হয় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার। আজ সেই উদ্যোগ পরিণত হয়েছে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশে। বিশেষ করে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা ও বিকাশ : বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যারয় আইন, ১৯৯২’-এর মাধ্যমে। সেই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই এই ধারা দ্রুত বিস্তৃত হয়। বর্তমানে (ইউজিসির হিসাব অনুযায়ী) দেশে প্রায় ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৬টি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ, ড্যাফোডিল, ব্র্যাক, ইন্ডিপেনডেন্ট, ইস্ট ওয়েস্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম ও গবেষণার জন্য ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করেছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প আশ্রয় : সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর ভর্তি হতে পারে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা লাখের ঘরে। আগে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে ওঠে বিকল্প আশ্রয়স্থল।
গুণগত শিক্ষার নতুন মানদণ্ড : প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ব্যবসায় প্রশাসন বা কম্পিউটার সায়েন্সের মতো জনপ্রিয় বিষয়ে সীমিত ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নানা ডিসিপ্লিনে বিস্তৃত হয়েছে- যেমন সাংবাদিকতা, আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিবেশবিজ্ঞান, ফার্মেসি, সমাজবিজ্ঞান, পাবলিক হেলথ ও ডেটা সায়েন্স। এ ছাড়া অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একাডেমিক সহযোগিতায় যুগ্ম ডিগ্রি, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের শুধু চাকরির জন্য নয়, উদ্যোক্তা হয়ে কর্মসংস্থানও তৈরি করছে। তরুণদের ‘জব সিকার’ নয়, ‘জব ক্রিয়েটর’ হিসেবে গড়ায় মনোযোগ দিচ্ছে।
দেশ ও বিদেশে কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্ব : দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে নিজেদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। কেউ বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ পদে, কেউ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন। আবার অনেকেই দেশে ফিরে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও স্টার্টআপ খাতে সফল উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন।
গবেষণা, উদ্ভাবন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি : এক সময় গবেষণা মানেই ছিল শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একচেটিয়া ক্ষেত্র। কিন্তু বর্তমানে ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইউল্যাব ও ড্যাফোডিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বখ্যাত জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করছে এবং আন্তর্জাতিক তহবিল পাচ্ছে।
বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সাইবার নিরাপত্তা ও কৃষি প্রযুক্তি খাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। সরকার এখন এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির’ সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছে।
নারী শিক্ষার প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানে নিরাপদ ক্যাম্পাস, নমনীয় সময়সূচি ও আধুনিক অবকাঠামোর কারণে নারী শিক্ষার্থীরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে নারীর উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতার পথও সুগম করেছে।
আরও পড়ুন:
ইবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে তালা!
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা : তবে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যে একই মানের শিক্ষা দিচ্ছে, তা নয়। কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান, শিক্ষক সংকট, গবেষণার ঘাটতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) আরও কঠোরভাবে মাননিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের একার পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে। আজকে দেশের উচ্চশিক্ষার মান ও বিস্তারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
শুধু ডিগ্রি অর্জনের বিষয় নয় : উচ্চশিক্ষা জাতির মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি গড়ে তোলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তার, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারী নেতৃত্বের বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর পথে অগ্রসর। এই যাত্রায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা, উদ্ভাবন ও দক্ষ মানবসম্পদই হতে পারে আগামী প্রজন্মের মূল চালিকাশক্তি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্র যদি তাদের সঠিকভাবে সহযোগিতা করে, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারবে।
তিন দশকের পথচলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। তারা শুধু সরকারি ব্যবস্থার ঘাটতি পূরণ করছে না; বরং জ্ঞান, প্রযুক্তি ও নেতৃত্ব বিকাশের নতুন অধ্যায় রচনা করছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান আরও গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে- এমন প্রত্যাশা শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের।