শ্রমিক থেকে মালিক, মিশর প্রবাসী মুজিবুরের সাফল্যের গল্প
পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে প্রতিদিন হাজারো তরুণ ছাড়ে প্রিয় মাতৃভূমি। কেউ ফিরে আসে স্বপ্নপূরণের গল্প নিয়ে, কেউ হারিয়ে যায় প্রবাস জীবনের অন্ধকারে। কিন্তু সেই হাজারো গল্পের মাঝে উজ্জ্বল এক নাম — মুজিবুর ইসলাম। মিশরের বুকে যিনি ঘাম আর অধ্যবসায়ে লিখেছেন এক আলোকিত ইতিহাস— শ্রমিক থেকে সফল শিল্পপতি হয়ে ওঠার গল্প।
১৯৯০ দশকের শুরুতেই মিশরে পা রাখতে শুরু করে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। ১৯৯৪ সালে ‘ডলফিন’ নামের একটি পোশাক কারখানায় ৭৫ জন বাংলাদেশির যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। এই প্রবাসীরা পরবর্তীতে “৭৫ গ্রুপ” নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন, যারা কায়রোসহ নানা শহরে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের নতুন স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেন।
এক সময় মিশরে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার। এখন তা কমে এলেও এখনও প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ঘাম ঝরাচ্ছেন নিরলস ভাবে। তাদেরই একজন ছিলেন বরিশালের হিজলা উপজেলার হরিনাথপুর গ্রামের ছেলে মুজিবুর ইসলাম।
২০০২ সালে হাতে স্বপ্ন আর মনে বিশ্বাস নিয়ে তিনি পাড়ি জমান মিশরে। কায়রোর এক পোশাক কারখানায় সাধারণ শ্রমিক হিসেবে শুরু হয় তাঁর প্রবাস জীবন। দিনে শ্রম, রাতে স্বপ্ন— এভাবেই এক দশক পেরিয়ে যায়। কঠোর পরিশ্রম, সততা আর অটল ধৈর্যের বিনিময়ে তিনি গড়ে তোলেন নিজের ভাগ্যের নতুন দিগন্ত।
আরও পড়ুন:
২৪ দিনে রেমিট্যান্স এল ১৪৯ কোটি ডলার
২০১০ সালে নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কায়রোর বাংলাদেশি অধ্যুষিত ইল মার্গ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ছোট্ট একটি পোশাক কারখানা — ‘রহমান অ্যাপারেলস’। কয়েকটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু হওয়া সেই ক্ষুদ্র উদ্যোগ আজ রূপ নিয়েছে বিশাল শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে কাজ করছেন দুই শতাধিক শ্রমিক, এর মধ্যে প্রায় সত্তরজন বাংলাদেশি। মাসিক আয় এখন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। তবে মুজিবুর ইসলামের চোখে এ সাফল্যের আসল কারণ— শ্রম, ধৈর্য, আর সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
মিশরে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও মুজিবুর ইসলামের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কেউ বিপদে পড়লে তিনিই আগে এগিয়ে আসেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
এই প্রতিবেদককে মজিবুর বলেন, ২০০২ সালে আমি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে এসেছিলাম মিশরে। আজ আল্লাহর কৃপায় শত শত মানুষের কর্মসংস্থান দিতে পারছি — এটাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন। যদি ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের জটিলতা না থাকত, আমি সব কাজই বাংলাদেশি ভাইদের দিতাম। তাহলে পুরো রেমিট্যান্সটাই যেত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে।
তবে সাফল্যের পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন প্রবাস জীবনের কষ্টের দিকটিও। মিশরে এখনো বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক নেই। বৈধ পথে টাকা পাঠাতে পারি না, বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে হয়। এতে অনেকেই ক্ষতির শিকার হন। সরকার যদি এখানে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খুলত, প্রবাসীরা অনেক উপকৃত হতো,”— বলেন এই পরিশ্রমী প্রবাসী উদ্যোক্তা।
বর্তমানে স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে কায়রোর ইল মার্গ এলাকায় বসবাস করছেন মুজিবুর ইসলাম।
তার মেয়ে নাজিয়া রহমান কায়রোর বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে সংসার পেতেছেন আমেরিকান প্রবাসীর সাথে। যা প্রমাণ করে পরিশ্রমের পাশাপাশি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে প্রবাসী এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মও।
মুজিবুর ইসলামের গল্প শুধু এক প্রবাসীর সাফল্য নয়, এটি এক বাংলাদেশির অনন্ত সম্ভাবনার গল্প— যেখানে শ্রমের প্রতিটি বিন্দু ঘাম একদিন পরিণত হয় সোনার ফসলে। তাঁর জীবন যেন প্রমাণ করে—
“ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় থাকলে, বিদেশের মাটিতেও ফুটে উঠতে পারে সাফল্যের বীজ।