উচ্ছেদ অভিযানে ডাকসু নেতারা, গঠনতন্ত্র কী বলছে

ঢাবি প্রতিনিধি
২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:০৫
শেয়ার :
উচ্ছেদ অভিযানে ডাকসু নেতারা, গঠনতন্ত্র কী বলছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে অবৈধ দোকান, উদ্বাস্তু, ভবঘুরে ও নেশাগ্রস্তদের উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে নানান সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। একপক্ষ বলছেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় উচ্ছেদ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’ আরেকপক্ষ দাবি করছেন, ‘শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা স্বার্থেই এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে।’  

শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাইফা ইসলাম মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকল প্রকার মাদকাসক্ত, ভবঘুরে মানুষ এবং অস্থায়ী দোকানগুলো অন্য জায়গায় স্থাপন করা দরকার। 

তিনি বলেন, ‘নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

প্রসঙ্গত, গত শনিবার (২৫ অক্টেবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের নেতৃত্বে পরিচালিত এই উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতারা। 

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে কি কোথাও উল্লেখ রয়েছে ডাকসু নেতারা চাইলেই এমন উচ্ছেদ অভিযানে অংশগ্রহণ করতে পারবে, এই প্রশ্নের জবাবে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এ বি জুবায়ের আমাদের সময়কে বলেন, ‘না, ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এমন কোনো বিষয় উল্লেখ নেই যে ডাকসুর সদস্যরা এই ধরনের অভিযানে অংশ নিতে পারবেন। তবে, আমরা যা করছি, তা মূলত প্রশাসনকে সহায়তা করার কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের নিয়মিত দায়িত্বের অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে থাকে। আমি ডাকসুর পক্ষ থেকে শুধু ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ের কাজ করছি এটুকুই।’

এদিকে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে বলছেন, উচ্ছেদের আগে বিকল্প ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমত, যারা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দোকান চালাচ্ছেন, তারা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। কারণ তাদের কোনো অনুমতি নেই। অবৈধভাবে যারা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন, তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবুও আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে সরকারের কাছে আহ্বান জানাব, যেন সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে থাকা ‘‘ভাসমান জনগোষ্ঠী পুনর্বাসন প্রকল্প’’-এর আওতায় এই মানুষগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। আমরা সে দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চাই ক্যাম্পাস যেন ভালো থাকে। ডাকসু হওয়ার পর আমরা একটা ফরমাল প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। সবাইকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে পারি এবং ফরমাল বডির মাধ্যমে কাজ করতে পারি । এই উচ্ছেদ অভিযানের সময় বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ছিল, সিটি কর্পোরেশন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, ডিএমপি, ট্রাফিক, মেট্রো কর্তৃপক্ষ, মেট্রো ডিডিএ সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেয়; ডাকসুর প্রতিনিধি থাকলে তারা কাজ করতে সাহস পান। কারণ অনেক সময় এগুলো কাজ করতে গিয়ে তারা ভয় পান।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আমরা চাই প্রতিদিন অ্যাকশন বাড়বে। বিকেলের পরে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে অতিমাত্রায় আসেন, এসব নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় খুঁজছি। আমাদের কিছু লিমিটেশন আছে। মানুষ ও রিসোর্সের সংকট রয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চাই, যাতে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে থাকতে পারেন।’ 

এদিকে এই উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার (২৫ অক্টোবর) হকার ও বহিরাগতদের উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হকারদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন বামপন্থীরা। 

এই উচ্ছেদের বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। ক্যাম্পাস এলাকায় মাদক বিক্রেতাদের নিশ্চয়ই চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। উচ্ছেদকৃত লোকজনের সঙ্গে আমরাও বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের দাবি সরকারের কাছে জানাই। কেননা কাজের অধিকার মানুষের মানবিক অধিকার।’

তিনি জানান, সরকারের উচিত তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও সরকারের সহযোগিতা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব মানবিক, সহনশীল, বিবেকবান, দায়িত্বশীল মানুষ তৈরি করা। সেখানে প্রক্টরিয়াল টিম এবং ডাকসুর নেতাদের নেতৃত্বে হকার, মানসিক ভারসাম্যহীন, উদ্বাস্তু মানুষদের ওপর শারীরিক আক্রমণ, নির্যাতন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অন্যদিকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক পোস্টে তিনি মন্তব্য করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ভবঘুরে-উদ্বাস্তু, নেশাগ্রস্ত কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন অথবা বীভৎস রোগাক্রান্তদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা জরুরি। তারা শিক্ষার্থীদের এবং বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনেক অনুমোদিত বা ভাসমান দোকানপাট রয়েছে। এর বেশিরভাগই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে। ক্যাম্পাসে দোকান পরিচালনার অনুমোদনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। একটি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমোদিত দোকানপাট চিহ্নিত করতে হবে। যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে স্থায়ী বা অস্থায়ী বা ভাসমান দোকান পরিচালনা করে আসছেন, একটি যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া তাদেরকে হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা সঠিক পদক্ষেপ নয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা উচ্ছেদ অভিযানের প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেন, ‘ডাকসুর গঠনতন্ত্রটা তো কোথাও দেখি না। কেউ শেয়ার করবেন, দেখি কোথায় লেখা আছে যে ডাকসুর নামে গুন্ডামি জায়েজ!’ 

এই মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এর পাল্টা জবাবে ডাকসুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ তার ফেসবুক আইডিতে মন্তব্য করেন, ‘শিক্ষক নেটওয়ার্কের কোনো গঠনতন্ত্র থাকলে শেয়ার করার অনুরোধ। দেখতে চাই তাদের গঠনতন্ত্রে কোথায় বলা আছে, ক্যাম্পাসে গানজুট্টি, জাতীয় মাদকাসক্তি, ভবঘুরে, পাগল, বহিরাগত, টোকাই ও অবৈধ সবকিছুকে শেল্টার দিতে হবে। বহিরাগত এনে ক্যাম্পাসের কর্মচারীদের রক্ত ঝরাতে হবে।’

আমাদের সময়/আরআর