লিটল ম্যাগাজিন বাংলা সাহিত্যের মেরুদণ্ড
বাংলা সাহিত্যে আলো করে আছে লিটল ম্যাগাজিন। সাহিত্যের আঁতুড়ঘর, যেখানে সাহিত্যিকদের জন্ম হয়। বাংলা সাহিত্যের মেরুদণ্ড, যাকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসা, স্বেদ, রক্ত, শ্রম। একে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সাহিত্যের আন্দোলন। অজানা-অচেনা লেখককে আবিষ্কারের আনন্দ। আইডিয়ালি বলা যেতে পারে, লিটল ম্যাগাজিন এক ধরনের অলটারনেটিভ অ্যাকটিভিটিজ। লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি এক ধরনের প্যারালাল লিটারেচার। কাজেই টেকনোলজির টো-টো করে এগিয়ে চলার সঙ্গে প্রকৃত লিটলম্যাগের কোনো সংঘাত নেই। ছোট কাগজ তৈরিই হয় বিশেষ একটি বলয় কেন্দ্র করে। এটা নিছক এক খণ্ড হাড় জিরজিরে পলকা শিল্পরূপের উপঢৌকন নয়; কেন্দ্রবিমুখ, প্রচলিত সংকলনের সর্পিল পথ থেকে ছিটকে আসা স্বকীয় প্রকরণ। এ যুদ্ধে মস্তিষ্কের কোষে কোষে জড়িয়ে থাকে তার চৈতন্য। ছোট কাগজ কোনো ব্যবসা নয়। এখানে শঠতার স্থান নেই। অর্থলোভের সম্ভাবনাকে সব সময় সে বাঁ-চোখের ইশারায় তাড়িয়ে দেয়। যিনি ছোট কাগজের জন্ম-মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন, তিনি এর প্রকৃত সম্পাদক হতে পারেন। তমসার সংহত রূপ যিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনিই কেবল জন্মের মৃত্যুসাক্ষী হতে পারেন। তাই টেকনোলজি এর বিষের ধারেকাছেও আসবে না। ভয় পাবে।
যে আকৃতিতেই প্রকাশ হোক, লিটল ম্যাগাজিনের অর্থকে বড় করে দেখার প্রবণতা ইদানীং নেই, যারা বের করেন তারাও ব্যাপারটা মুলোর মতো ঝুলিয়ে রাখেন। লিটল ম্যাগাজিন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল, রাগী-লেখকদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু বরাবর তা-ই হয়ে আসছে, কেননা এখানেই রয়ে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের প্রকৃত চরিত্র। প্রতিশ্রুতিশীল অথচ প্রতিভাবান তরুণ লেখকরা যখন প্রতিষ্ঠিতদের বিরুদ্ধবাদী হয়ে ওঠেন, প্রতিষ্ঠিত কাগজগুলোর বাজারি মনোভাব তাদের ক্রিয়াশীল চেতনা যখন ভিন্ন খাতে বইয়ে দিতে চায়, তখন এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি না-সূচক মনোভঙ্গি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে। লিটল ম্যাগাজিনের পাতা তারুণ্যের সদম্ভ পদপাদে উচ্চকিত, মূলত তারুণ্যনির্ভর, পাণ্ডিত্যনির্ভর নয়, রচনার ভালো-মন্দের বিচার এখানে গৌণ, প্রকাশ আকাক্সক্ষাই হবে মুখ্য। চঞ্চল অথচ মেধাসম্পন্ন, রক্তবর্ণ তলোয়ারসদৃশ লিটল ম্যাগাজিনই পারে সাহিত্যের সর্ববাঁক শরীরে ধারণ করতে, নতুনত্বের দুয়ার খুলে দিতে।
লিটল ম্যাগাজিনের আলাপে নানা মতভেদ, চিন্তার পার্থক্য থাকলেও এর প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে, সামষ্টিক পুঁজি বা পুঁজিবাদী মানসের বিরুদ্ধে জুতসই লড়াই চালিয়ে যাওয়া। যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘অপর্যায়িক’, সে কারণেই এসব পত্রিকার দীর্ঘস্থায়িত্ব কোনোক্রমেই আশা করা যায় না। এতে থাকে না সম্পাদকীয় বিধিনিষেধ অথবা প্রবীণের প্রচণ্ড বিমুখতা। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের পশ্চাতে তরুণদের যে পরিমাণ কায়িক শ্রম, অর্থ ব্যয় হয় সেই পরিমাণে অর্থ দ্বারা লাভবান হওয়ার আশা দুঃসাধ্য- লাভ কেবল আত্মতৃপ্তি। যথার্থ লিটলম্যাগ, তার অভীষ্ট ক্ষেত্র হবে ভিন্ন, সংগতি রক্ষা নয়। প্রবীণ প্রতিষ্ঠিতদের ভজনালয়ে নিজেকে দাঁড় করানোর কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করে না, মুগ্ধ করার চাতুর্য তার নেই। তার মূলে থাকবে ঐতিহ্য, সব অস্তিত্ব আর অনাগত ভবিষ্যতের অনুসন্ধান।
তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের অনেক ছোট কাগজের সম্পাদকরা নানাভাবে আপসের মানসিকতা নিয়ে চলছেন। সংগ্রামী, আপসহীন বা দারুণ মেধাবী সম্পাদকের অভাব আমাদের আছে। প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষ যেমন একান্তভাবে অনন্য, তার দৃষ্টিভঙ্গিও তেমনই একান্ত অনন্য। ছোট কাগজের কনসেপ্টটা বলতে গেলে আজ এপার-ওপারে কিছুটা হলেও বেঁচে আছে। যে উদ্দেশ্যে, যে ব্রত নিয়ে সমাজ, রাজনীতি বলতে গেলে নিজের বিত্তকে ভেঙে তারুণ্যের অগ্নি আস্ফালন ঘটে- আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সংশয় জাগে, সত্যিই কি তাদের সেই স্টেমিনা আছে? কাজেই ছোট কাগজ করি, দুমদাম করে বলাটা যত সহজ, করাটা তত সহজ নয়। এস্টাবলিশমেন্ট কে না চায়! হঠকারীর এই দুনিয়ায় কে আর অ্যান্টি থাকতে চায় বলুন! যে বীজটা সবেমাত্র রোপিত হয়েছিল, তাকে তো বাড়তে দিতে হবে। কোন ওয়েদারে কোন কীটনাশকে, কোন খাদ্যে কতটুকু বড় করবেন, কী ফল আশা করছেন- এ সবই আজ গোড়ার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে তো সে সময়টুকুই দেওয়া হলো না। বোঝার আগেই বুঝে গেলাম আমরা। গাছে না পাকিয়ে অর্থের লোভে কাঁচাতেই কেমিক্যালে চোবালাম। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে প্রকৃত লিটলম্যাগ।
স্বতন্ত্র হওয়ার মধ্যে আলাদা একটা মজা আছে। ছোট কাগজের এই হয়ে ওঠাটা অতি জরুরি শর্ত। ব্যক্তি যখন নিজেকে একটি ক্ষমতা-নির্দিষ্ট ছকে মিলিয়ে নেয়, তখনই সে তার অস্তিত্বের প্রশ্নে আপস করে। আপাতদৃষ্টিতে খুঁজে না পাওয়া গেলেও শতকরা সিংহভাগ ছোট কাগজের পেছনে আছে পুঁজির পাঁয়তারা। আর রাষ্ট্র থাকে চালকের ভূমিকায়। সুতরাং তারা চাইবে তাদের মতো সবকিছু হোক, চলুক একমাত্রিক। প্রতিষ্ঠান এক অর্থে সাহিত্য-শিল্প ভুবনে পদচারণকারীদের ক্রমশ করে তোলে অথর্ব, দাস, অস্বাধীন।
লিটল ম্যাগাজিন অর্থই তারুণ্য, উৎসাহ, উদ্দীপনা, বিদ্রোহ, অচলায়তন ভাঙা। তার চারিত্রিক রূপরেখা হবে প্রতিষ্ঠাবিরোধী হওয়া, অপ্রতিষ্ঠদের জায়গা দেওয়া, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ, অতি-তরুণ লেখকদের একত্রিত করা। যে কোনো টেক্সটকে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে মাধ্যমের দ্বারস্থ হতে হয়। আমাদের কথা আমাদের মতো উচ্চারণে ভূতগ্রস্ত পৃথিবীকে ঘিরে ধরবে। প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যবুদ্ধির দুঃস্বপ্নে ভীত হব না, এমন মন্ত্রই প্রকারান্তরে করে যাচ্ছেন প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরা। া
আরও পড়ুন:
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন