পেশা হিসেবে হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেফটি স্পেশালিস্ট
আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি। কলকারখানার রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা এবং অফিস-আদালতের অগ্নিনির্বাপণের মহড়া প্রভৃতি বিষয় দেখভাল করার জন্য সেফটি ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন নিত্যদিন বেড়েই চলেছে। আর এই চাহিদার জন্যই হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেফটি স্পেশালিস্ট বা সেফটি ইঞ্জিনিয়ার/অফিসার হয়েছে উঠেছে আজকের দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ার অপশন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস
সেফটি আর সিকিউরিটি এ দুটি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে দামি জিনিস। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর উপার্জনের পরই মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামায়। আধুনিক বিশ্বের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে জটিলতা যত বাড়ছে, নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে মানুষ আর সমাজ। তাই নিরাপত্তাহীনতা কাটাতে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলার আকাক্সক্ষা সর্বত্র। শিল্প ও সামাজিক ক্ষেত্রে আজকের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা বা সেফটি ম্যানেজমেন্ট। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের ভয়ংকর সংক্রমণসহ কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা কত জরুরি। শুধু কি অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধস? রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ভূমিকম্প, বন্যা, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, সংক্রামক রোগ। চুরি-ছিনতাই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষের মতো দুর্যোগও রয়েছে।
কাজের সুযোগ: কলকারখানায় শিল্প দুর্ঘটনা ও পেশাগত স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশজনিত বিভিন্ন দুর্ঘটনা সবার চোখ খুলে দিয়েছে। যে কোনো শিল্পে কর্মচারীদের নিরাপত্তার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে প্রাণহানি, সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো বিষয়গুলো থাকে। আর এসব সামাল দেওয়ার জন্যই সেফটি ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন হয়। এককথায় দুর্যোগ মোকাবিলা করে জান ও মালের হেফাজতের জন্য সেফটি ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন নিত্যদিনই বাড়ছে। আর এই চাহিদা তৈরি হওয়ায় আজকের দিনে অন্যতম ক্যারিয়ার অপশন সেফটি ম্যানেজমেন্ট, বিপদঘণ্টা বেজে ওঠার আগেই যারা সামলে নেবে সবকিছু। তাই অন্যের জীবনকে সেফ করতে ‘হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেফটি স্পেশালিস্ট’ হয়ে আসতে পারেন এই পেশায়।
হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেফটি স্পেশালিস্ট যেসব কাজ করেন : ডিফেন্স সার্ভিস; সিভিল ফায়ার স্টেশন; পৌরসভা; পাওয়ার স্টেশন; কার্গো হাব, জাহাজ; ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম; টেক্সটাইল; তৈরি পোশাক শিল্প; কটন ইন্ডাস্ট্রি; প্লাস্টিক-পলিমার; রেলওয়ে; তেল প্রস্তুতকারক সংস্থা; বিমানবন্দর; বড় বড় শিল্পক্ষেত্র; হাসপাতাল।
দায়িত্ব : অগ্নিনির্বাপণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং জরুরি অবস্থায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; যেকোনো দুর্ঘটনার তদন্তদলের সঙ্গে অনুসন্ধানে অংশ নেওয়া এবং দুর্ঘটনার কারণ উদ্্ঘাটন করা; পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির দেখাশোনা করা; নিয়মিত ড্রিল পরিচালনা করা; ISO 14001 & OHSAS 18001 নিশ্চিত করা;
আরও পড়ুন:
আউটলেট ম্যানেজার নিচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ
যোগ্যতা : একজন হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সেফটি স্পেশালিস্টের যে ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয় তা হলো :
মেকানিক্যাল/সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং; পরিবেশবিজ্ঞানে বিএসসি (সম্মান); ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা; হেলথ সেফটি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের ডিপ্লোমা ডিগ্রি ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা; ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজমেন্টে এমবিএ; ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিটেক হ্যাজার্ট ম্যানেজমেন্ট;
কোর্স ও যোগ্যতা : শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বা সেফটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে আমাদের দেশে সেভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা শুরু হয়নি। তার পরও বিভিন্ন ধরনের কোর্স রয়েছে। এ বিষয়ে আগ্রহীরা চাইলে দেশের বাইরে থেকে ডিগ্রি আনতে পারে, যেমন- ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা; হেলথ সেফটি অ্যান্ড এনভায়রমেন্টের ডিপ্লোমা ডিগ্রি ও পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা; ফায়ার অ্যান্ড সেফটি ম্যানেজমেন্টে এমবিএ; ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিটেক হ্যাজার্ট ম্যানেজমেন্ট। কোর্স অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, পলিটেকনিক, গ্র্যাজুয়েট। সাধারণভাবে বলা যায়, সেফটি ম্যানেজমেন্ট পড়ার জন্য যোগ্যতা লাগে নন-টেকনিক্যাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা টেকনিক্যাল।
পাঠ্যক্রম ও মূল বিষয় : সেফটি ম্যানেজার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষ করে তুলতে সাধারণভাবে পাঠ্যসূচিতে পড়তে হয় প্রিন্সিপাল অব ম্যানেজমেন্ট, অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার (ওবি), হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (এইচআরএম), মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট (এমএম), ফান্ডামেন্টাল অব সেফটি অ্যান্ড ল, ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, সেফটি ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোজাল অ্যানালিসিস, ইন্সপেকশন অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রসিডিউর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাইজিন অ্যান্ড অকুপেশনাল হেলথ, এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন, প্রোডাকশন অ্যান্ড মেটেরিয়ালস ম্যানেজমেন্ট, সেফটি ইন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, সেফটি ইন ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি বিষয়।
পড়াশোনা : মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল এবং সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সেফটি ম্যানেজমেন্ট পড়ানো হয়। তাই পেশা হিসেবে পড়তে চাইলে রয়েছে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। অনেক জায়গায় আর্লি ওয়ার্নিং ম্যানেজমেন্ট (Early Warning Management) হিসেবে পড়ানো হয়।
এ ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়ার জন্য রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস; ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্টের ওপর সার্টিফিকেট কোর্স আছে; এ ছাড়া শর্ট কোর্সের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের দুই দিনব্যাপী ফায়ার সেফটি ম্যানেজমেন্ট ইন গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি কোর্স।
আয়-রোজগার : প্রতিষ্ঠানভেদে মাসিক আয় ২০,০০০-৩০,০০০ টাকা হতে পারে। অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে মাসে আরও অনেক টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে।
ক্যারিয়ার গ্রাফ : আজকাল প্রায় প্রতিটি কলকারখানা ও অফিসের অন্যতম বিষয় জানমালের নিরাপত্তা, নিরাপত্তাবিধানের যন্ত্র ও কৌশল। আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ জনশক্তির চাহিদা বেড়েছে বিগত কয়েক বছরে কয়েক গুণ। ভালো আয়, পদোন্নতি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন এই পেশায় ঝুঁকি থাকলেও চ্যালেঞ্জিং এই পেশা হতে পারে আপনার কাক্সিক্ষত ক্যারিয়ার।