বই পড়া আমাদের বাঁচার শক্তি দেয়-লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

পল্লব শাহরিয়ার
১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩৮
শেয়ার :
বই পড়া আমাদের বাঁচার শক্তি দেয়-লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

অত্যন্ত নীরব, তবু গভীরভাবে জাগ্রত এক মানুষÑ লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ২০২৫ সালের অক্টোবরের সকালে, ফ্রাংকফুর্টে এক অসুস্থ বন্ধুর ফ্ল্যাটে বসে তিনি নিজেই শুনলেন, তার নাম ঘোষণা হয়েছে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য। এই খবর যেন তাকে মুহূর্তেই নীরব করে দেয়। নোবেল কমিটি থেকে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলা হয়, সেই সাক্ষাৎকারে ক্রাসনাহোরকাই কথা বলেছেন তার একাকী লেখালেখি নিয়ে, তিক্ততা থেকে জন্ম নেওয়া প্রেরণা নিয়ে আর বই ও কল্পনার শক্তি নিয়ে, যা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, অন্ধকার সময়েও টিকিয়ে রাখে। তার এই সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো। অনুবাদ করেছেন পল্লব শাহরিয়ার

‘আমি সত্যিই গর্বিত যে, আমি এমন এক দীর্ঘ ধারায় যুক্ত হতে পেরেছি, যেখানে আছেন অসাধারণ সব কবি ও লেখক।’ নতুন নোবেল সাহিত্যজয়ী লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এই সাক্ষাৎকারে তার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, এই পুরস্কার তার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। কথায় কথায় তিনি আরও বলেন, তার লেখার এক বড় চালিকাশক্তি হলোÑ ‘তিক্ততা’ জীবনের ক্ষত, আঘাত ও অভিমান থেকেই তিনি লেখার প্রেরণা পান। তবু তার কাছে সবচেয়ে জরুরি হলো কল্পনাশক্তি। ‘কল্পনা না থাকলে জীবন একেবারেই অন্যরকম হতো,’Ñ বলেন তিনি। ‘বই পড়া আমাদের বাঁচতে শেখায়, বাঁচার শক্তি দেয়। প"থিবীর এই ভয়াবহ সময়েও পাঠই আমাদের টিকিয়ে রাখে।’

জেনি রিডেন (নোবেল প্রাইজ ফাউন্ডেশন) : হ্যালো?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : হ্যাঁ, বলুন।

জেনি : আমি জেনি রিডেন, নোবেল প্রাইজ থেকে বলছি।

ক্রাসনাহোরকাই : ওহ, হ্যাঁ!

জেনি : আমি কি লাসলো ক্রাসনাহোরকাই-এর সঙ্গেই কথা বলছি?

ক্রাসনাহোরকাই : হ্যাঁ, আমিই।

জেনি : প্রথমেই অভিনন্দন, আপনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জিতেছেন।

ক্রাসনাহোরকাই : অনেক ধন্যবাদ। সত্যিই ধন্যবাদ।

জেনি : এখন আপনার কেমন লাগছে?

ক্রাসনাহোরকাই : (হেসে) এটা তো এক রকম বিপর্যয়! (হাসেন) আমি এখন ভাবছি স্যামুয়েল বেকেটের কথা, যখন তিনিও নোবেল পেয়েছিলেন। রিপোর্টে লিখেছিল, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি, তিনি শুধু একটা কথা বলেছিলেন : ‘ডযধঃ ধ পধঃধংঃৎড়ঢ়যব!’Ñ ‘কী বিপর্যয়!’ আমি তাই বলছি, এটা তার চেয়েও বড় বিপর্যয়। কারণ এটা একদিকে যেমন অবিশ্বাস্য আনন্দ, তেমনি এক অদ্ভুত ভয়ও বটে। আমি গর্বিত, আমি খুশি। এমন এক ধারায় যুক্ত হতে পারা, যেখানে আছেন এত সব অসাধারণ কবি, ঔপন্যাসিক, মানব আত্মার অনুবাদক, এ যেন আমাকে নতুন শক্তি দেয় আমার মাতৃভাষায় লেখার জন্য। আমি হাঙ্গেরীয় ভাষায় লেখি, এক ছোট ভাষা, কিন্তু তার ভেতরেই আমি আমার পৃথিবী খুঁজে পাই। এই ভাষায় লেখার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত, কৃতজ্ঞ। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিতে চাই পাঠকদের, যারা এখনও বই পড়ে, যারা এখনও কল্পনা করতে জানে। আমি চাই, মানুষ যেন আবার কল্পনা করার ক্ষমতাটা ফিরে পায়। কারণ কল্পনা ছাড়া জীবন একেবারেই অন্যরকম হয়ে যায়। বই পড়া আমাদের বাঁচার শক্তি দেয়, আমাদের ধনী করে তোলেÑ অর্থবিত্তে নয়, অনুভূতিতে। বই পড়া আমাদের কঠিন পৃথিবীতে ভালোভাবে বাঁচতে ও টিকে থাকতে সাহায্য করে।

জেনি রিডেন : আচ্ছা, আপনি আমাদের একটু বলুন কোথায় আছেন এখন? যখন খবরটা শুনলেন, তখন মুহূর্তটা কেমন ছিল?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : আমি এখন ফ্রাংকফুর্টে, এক বন্ধুর ফ্যাটে। সে অসুস্থ, তাকে দেখতে এসেছিলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। মনে হচ্ছে, যেন কেউ ভুল করেছে! তবু আমি ভীষণ খুশি।

জেনি রিডেন : আপনি একেবারেই আশা করেননি?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : একেবারেই না। আমি কোনোদিন ভাবিনি। পুরোপুরি অবাক হয়ে গেছি।

জেনি রিডেন : আপনার লেখার সবচেয়ে বড় প্রেরণা কোথা থেকে আসে?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : তিক্ততা থেকে। আমি যখন পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবি, তখন গভীর দুঃখে ভরে যাই। সেই দুঃখটাই আমার লেখার শক্তি। এই তিক্ততাই হয়তো পরের প্রজন্মের জন্যও এক ধরনের অনুপ্রেরণা হতে পারে, যে কোনো অন্ধকার সময়েও বেঁচে থাকার ইচ্ছা টিকিয়ে রাখতে হবে। আমরা এখন এমন এক যুগে বেঁচে আছি, যেখানে টিকে থাকতে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তির দরকার।

জেনি রিডেন : এই যে আপনি বলছেনÑ অন্ধকার সময়, সেখানে লেখালেখি আপনাকে কতটা সাহায্য করে বেঁচে থাকতে?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : লেখাটা আসলে খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি সাধারণত কখনই নিজের কাজ নিয়ে কথা বলি না, অন্য লেখক-বন্ধুদেরও দেখাই না। আমি একটা বই লিখি, তারপর প্রকাশকের হাতে দিই, তারপর কিছুদিন চুপ থাকি। তারপর একদিন আবার শুরু করি, আগের চেয়ে ভালো কিছু লেখার চেষ্টা করি। এভাবেই আমার জীবন চলে।

জেনি রিডেন : শুনেছি, আপনি এক জায়গায় থাকেন না, ঠিক? একাধিক শহরে আপনার বাড়ি আছে?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমি হাঙ্গেরিতে থাকিÑ বুদাপেস্টের কাছেই, পাহাড়ের ওপর একটা ছোট বাড়ি। এ ছাড়া ট্রিয়েস্তে (ঞৎরবংঃব) আর কখনও কখনও ভিয়েনাতেও থাকি। পুরনো অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের ভেতরেই ঘুরে বেড়াই, বলতে পারেন।

জেনি রিডেন : এই আনন্দটা উদ্যাপন করবেন কীভাবে?

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : আজ আমার আসলে একটা প্রশাসনিক কাজ ছিল, জার্মানিতে নতুন ঠিকানাটা রেজিস্ট্রি করাতে যাচ্ছিছলাম। (হাসেন) তাই খবরটা পাওয়ার পরও পরিকল্পনা বদলাতে পারিনি। সন্ধ্যায় হয়তো ফ্রাংকফুর্টে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ডিনার করব, সামান্য পোর্ট ওয়াইন আর শ্যাম্পেন থাকবে।

জেনি রিডেন : দারুণ শোনাচ্ছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : আপনাকেও ধন্যবাদ।

জেনি রিডেন : আবারও অভিনন্দন।

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই : ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।

জেনি রিডেন : বিদায়।