মালির হাজার বছরের নির্দশন মসজিদ গ্রেট মস্ক অব জেনি
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি। দেশটির উত্তরে প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি, আর বাকি অংশ জুড়ে রয়েছে সবুজ তৃণভূমি।
দেশটিতে রয়েছে হাজার বছরের পুরনো স্থাপনা একটি মসজিদ। সম্পূর্ণ কাদামাটি দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ মালির জেনি এলাকায় অবস্থিত। মসজিদটি গ্রেট মস্ক অব জেনি নামেই অধিক পরিচিত বিশ্বজুড়ে।
সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে নির্মিত জেনির গ্রেট মসজিদ কবে নির্মিত হয়েছিল তা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত। ধারণা করা হয়, ১২০০ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদ সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো দলিলটি হলো আব্দুল আল-সাদি রচিত ‘তারিক আল-সুদান’ বা ‘সুদানের ইতিহাস’ গ্রন্থটি। ১৬৫৫ সালের আগে এই বইটি রচনা করা হয়।
এই বর্ণনা অনুযায়ী, জেনির ২৬তম শাসক কোনবোরোর হাতে এই মসজিদের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়। তিনি একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম ছিলেন। নিজের বাসস্থানটিকেই তিনি মসজিদে রূপ দিয়েছিলেন এবং মসজিদের পূর্বদিকে কাছাকাছি এলাকায় নিজের জন্য আরেকটি প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। তবে, সেই প্রাসাদ মসজিদের চেয়েও ছোট ছিল।
জেনির সাধারণ মানুষ তখন ব্যাপক উৎসাহে গ্রহণ করে নেন তাদের প্রথম মুসলমান শাসককে। তখন নতুন রাজা চিন্তা করেন তার প্রজাদের প্রার্থনার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান দরকার। যেখানে সৃষ্টিকর্তার জন্য স্থান নেই সেখানে তিনি কী করে প্রাসাদে বাস করবেন? তিনি ঠিক করলেন তার প্রাসাদ ভেঙে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে ডেকে আনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মসজিদ তৈরিতে গতানুগতিক কাদামাটি এবং গ্রামের সাধারণ জিনিসপত্র ব্যবহার করা হবে।
আরও পড়ুন:
কোন সময় দোয়া করলে বেশি কবুল হয়?
মসজিদের দেয়াল অনেক উঁচু হবে বলে সেখানে তালগাছের কাঠ দিয়ে নকশা করা হলো যা স্থানীয়ভাবে টরল নামে পরিচিত। মাটির দেয়াল যাতে সহজে ধসে না পড়ে সে জন্যই এই কাঠ ব্যবহার করা হতো। রাজা কোনবোরোর উত্তরসূরিরা মসজিদের আরও ব্যাপক সংস্কার করেন। তারা এই মসজিদের সঙ্গে আরও দুটি মিনার নির্মাণ করেন এবং মসজিদের চারপাশে উঁচু দেয়াল তোলেন।
১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই মসজিদ সম্পর্কে কোনো প্রকার লিখিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সেবার ফরাসি পর্যটক রেনে কাইলি মালি ভ্রমণের সময় জেনিতে গিয়ে মসজিদটি খুঁজে বের করেন। জার্নাল অব দ্য ভয়েজ টু টিম্বাকটু অ্যান্ড জেনিতে রেনে কাইলি লিখেন, ‘জেনিতে মাটি দিয়ে নির্মিত এক মসজিদ রয়েছে। খুব বেশি উঁচু না হলেও বিশাল আকারের দুটি টাওয়ার রয়েছে এই মসজিদে। অনেক বড় আয়তন নিয়ে মসজিদটি বানানো হয়েছে। মসজিদের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার চড়–ই পাখির বসবাস। তারা সেখানে বাসা বানিয়ে থাকে।
রেনে কাইলিই ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি মসজিদটি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে নিজের চোখে দেখেছিলেন। তিনি তার প্রবন্ধে এও উল্লেখ করেন মসজিদের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত কাদামাটির প্রলেপ দেওয়ার প্রয়োজন হতো। তিনি ধারণা করেন, অনেক বছর অবহেলায় পড়ে থেকে মসজিদটির স্থায়িত্ব কমে এসেছিল।
রেনে কাইলির ভ্রমণের ১০ বছর আগে ফালানি নেতা সেকু আমাডুর নেতৃত্বে এক জিহাদের মধ্য দিয়ে জেনি শহর দখল করে নেওয়া হয়। খুব সম্ভবত সেকু আমাদু ওই মসজিদটিকে অস্বীকার করেছিলেন এবং অবহেলার দরুন এর করুণ দশার সৃষ্টি হয়। আর এমন পরিস্থিতিতেই মসজিদ এলাকায় ভ্রমণ করেন রেনে কাইলি। কথিও আছে সেকু আমাদু ওই শহরের আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে, তার নেতৃত্বেই ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে মাটির মসজিদের পূর্বদিকে যে প্রাসাদটি ছিল সেখানে দ্বিতীয় আরেকটি মসজিদ নির্মিত হয়। এই মসজিদ আগের মসজিদের তুলনায় অনেক বড় ছিল। তবে, এই মসজিদের ভবনগুলো তুলনামূলক নিচু ছিল এবং এতে টাওয়ার কিংবা সাজসজ্জা কম ছিল। ১৮৯৩ সালে লুইস আর্কিনার্ডের নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী জেনি অঞ্চল দখল করে নেয়। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবোইস জেনিতে ভ্রমণ করেন এবং আসল মসজিদটির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বর্ণনা করেন। পরিত্যক্ত মসজিদটির ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। এটিকে তখন একটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ১৮৯৭ সালে ডুবোইস-এর লেখা ‘টম্বোকটো লা মিস্ট্রিজ’ বইয়ে এ সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করেছিলেন এবং নিজের হাতে আঁকা একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। মসজিদটি ধ্বংস ও পরিত্যক্ত হওয়ার আগে এটি দেখতে কেমন ছিল, তা কল্পনা শক্তির ওপর নির্ভর করে এঁকেছিলেন ডুবোইস।
আরও পড়ুন:
হজ নিবন্ধনের সময় বাড়ল ২১ দিন
১৯০৬ সালে ফরাসি প্রশাসন আসল মসজিদটিকে আবারও নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেকু আমাদু যে মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন সেটিকে একটি স্কুলে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করা হয়। মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দেন ইসমাইলা ট্রাওরি নামে এক রাজমিস্ত্রি সর্দার। এই নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল জেনির সাধারণ মানুষও। সে সময়ের কিছু ছবি দেখে ধারণা করা হয়, আসল মসজিদের সীমানা দেয়ালগুলো আগের মতো করে নির্মাণ করা হলেও ভেতরের স্তম্ভ নির্মাণে আগের রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল কি-না তা এখনো অস্পষ্ট।
নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে কিবলা ওয়ালের ওপর স্থাপিত তিনটি টাওয়ার প্রতিসম ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়। মসজিদের পুনর্র্নিমাণে ফরাসি ভ‚মিকা নিয়ে অনেক বিতর্কও রয়েছে। কারও কারও মতে, ফরাসিদের কোনো ভ‚মিকা ছাড়াই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।
ফেলিক্স ডুবোইস দ্বিতীয়বারের মতো জেনি সফর করেন ১৯১০ সালে। নতুন মসজিদ দেখে তিনি কিছুটা মর্মাহত হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, মসজিদটি নির্মাণ করতে গিয়ে ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসন এর কিছুটা বিকৃতি ঘটিয়েছে। কারণ ডুবোইসের মনে হচ্ছিল নতুন মসজিদটিতে একটু চার্চের আদল রয়েছে এবং এটি অনেকটা বারোক স্থাপত্যের মন্দিরের মতো দেখাচ্ছে। তবে, তার এই মতামতের তীব্র বিরোধিতা করেছেন আমেরিকার স্থাপত্য ইতিহাসবিদ জিন লুইস বারগেনাস। তার মতে, নতুন করে নির্মিত মসজিদটিতে ফরাসি প্রভাব নেই বললেই চলে। এছাড়া এর ভেতরে যেসব নকশা করা হয়েছে তার সবগুলোর উৎস আফ্রিকান।
মসজিদের দেয়ালগুলো ইটের মতো এক ধরনের মাটির টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো রোদে শুকানো। এর ওপর মাটির আবরণ দিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ভবনের দেয়ালগুলোতে তালগাছের পাতার কাণ্ড দিয়ে বিশেষ নকশা করা হয়েছে। প্রতি বছর মসজিদের নির্মাণকাজে এই কাণ্ডগুলো বিশেষ ভমিকা রাখে। কারণ এগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই শ্রমিকরা কাজ করে। ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মসজিদের ভিত্তিভ‚মিটি দৈর্ঘ্য প্রস্থ দুই দিকেই ৭৫ মিটার করে। সমতল থেকে এই ভ‚মি প্রায় ১০ ফুট উঁচু। ওই অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলা বানি নদী প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হলে যেন মসজিদের কোনো ক্ষতি না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। উত্তর দিক দিয়ে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মসজিদের ভেতরে যেখানে নামাজ পড়া হয় সেই অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২৬ মিটার।
আরও পড়ুন:
মালিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মিশন শেষ করল জাতিসংঘ