বকুলতলায় বর্ণিল আয়োজনে শরৎ উৎসব উদযাপন
'ষড়ঋতু উদ্যাপন জাতীয় পর্ষদের উদ্যোগে বর্ণিল আয়োজনে রাজধানীতে উদযাপিত হয়েছে শরৎ উৎসব ১৪৩২। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় কবিতা, গান, নৃত্য ও কথামালায় এ উৎসব হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
ষড়ঋতু উদযাপন জাতীয় পর্যদের আহ্বায়ক এহসান মাহমুদের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হয় এ আয়োজন। তিনি বলেন, আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি, সেখানে ছয় ঋতুর কথা লেখা ছিল। তার একটি হচ্ছে শরৎ। কিন্তু শরৎকে আমরা আজ ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট দিন মেনে উদযাপন করছি না। বাস্তবে শরৎ এসেছে আমাদের জীবনে অনেক আগেই। ঋতুবৈচিত্র্যের নিয়ম মেনেই শরৎ এসেছিল, কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে আমরা তখন সেটিকে বরণ করতে পারিনি। তবে তাই বলে কাশ ফুল ফোটা বন্ধ হয়নি, শরতের আকাশ নীল হওয়া বন্ধ হয়নি। শরৎ তার সহমহিমায় এখনও আমাদের সামনে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
তিনি আরও বলেন, একসময় আমরা যে সম্প্রীতির বাংলাদেশের কথা বলতাম, সেই চিত্রে এখন যেন কোথাও ছেদ ঘটেছে। শুধু রুচির ভিন্নতার কারণে, পোশাকের ভিন্নতার কারণে, খাদ্যাভ্যাস বা চুল রাখার ধরনে ভিন্নতার কারণে কেউ কেউ এখন আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে নিষেধাজ্ঞা।সব ধর্মের, সব বর্ণের, পাহাড়ি ভাইয়ের কিংবা সমতলের বোনের সবাই মিলেই হবে সেই বাংলাদেশ।
গত বছর জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে এহসান মাহমুদ বলেন, এই লড়াই থেকে আমরা উপলব্ধি করছি, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্য। কিন্তু বৈষম্য নিরসনের নামে আমরা এমন কিছু করছি, যা নতুন বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে কিংবা পুরোনো বৈষম্য ফিরিয়ে আনছে। এই জায়গা থেকে আমাদের বের হতে হবে।
উৎসবে শরৎ নিয়ে কথামালায় অংশ নেন দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক আবু সাঈদ খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, লেখক, কবি ও পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ, জাতীয় কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, কবি লতিফুল ইসলাম শিবলিসহ আরও অনেকে।
শরৎ নিয়ে আমাদের সময় সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, বর্ষা কিংবা বসন্ত নিয়ে বিদ্রোহ হয়েছে, অনেক বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর উঠেছে। কিন্তু শরৎ নিয়ে কোনো দ্রোহের কাহিনি নেই। এমনকি বিদ্রোহী কবি নজরুলও শরতের কাছে এসে শান্ত ও শুভ্র হয়ে পড়েছেন। আমার কাছে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শরতের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক আছে। কিন্তু যত নগরায়ণ হচ্ছে, আমরা ততই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ১৯০৫ সালে শরৎে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ নিরসনের জন্য রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রাখি বন্ধন উৎসব করেছিলেন। আমার মনে হয়, এখনো সেই রাখি বন্ধন দরকার।
তিনি আরও বলেন, এই দেশ গড়ার জন্য, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এবং সর্বশেষ ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়েছি। কবিতা, গান, আবৃত্তি, শিল্পীর তুলিতে আমাদের সেই সংহতির আবহ তৈরি করতে হবে। পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে।
শরতের বৈচিত্র্যর কথা উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, শরৎ একটি কোমল ও মিষ্টি ঋতু, যেখানে গ্রীষ্ম বা শীতের চরমতা নেই। যাদের মনের কোমলতা কম, তাদের পক্ষে শরৎ এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা কঠিন। কাশফুলের নরমতা, নীল আকাশ, মেঘ, চাঁদ ও তারা সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে এই ঋতুতে।তিনি বলেন, সব দেশে এই রূপ নেই, আমাদের দেশেই প্রকৃতি এভাবে ধরা দেয়। দেশের জটিলতার মাঝেও প্রকৃতি আমাদের সম্ভার। আশ্বিন ও কার্তিক মাসে শরৎ এর আবহ সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়। আমি বিশ্বাস করি, নাগরিক পরিসরেই প্রকৃতির আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব। আমাদের কবিতা, গান ও নৃত্যের মাধ্যমেই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পিআইবি'র মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, সংস্কৃতির বিষয়টাকেও আমাদের কাছে অনেক সময় একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার হিসেবে হাজির করা হয়। অথচ আমরা যা করি, যা চলি, যা বলি তাই তো সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা দেখেছি, ফ্যাসিবাদের আমলে এখানে একটা উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতির মতো করে একটা জিনিসের চর্চা হতো। আমাদের দেশেও এই ১৫ বছরে আমরা অনেক বড় বড় উৎসব, বড় বড় প্রকল্প সংস্কৃতির নামে হতে দেখেছি। কিন্তু কার্যত এই ১৫ বছরে আমরা এমন কোনো বড় সাহিত্য পাইনি, পাইনি বড় কাব্য, বড় নাটক কিংবা চলচ্চিত্র। এখন আমরা সেই রুগ্ন দশা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি।
আরও পড়ুন:
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
শরৎ নিয়ে কথামালার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। গান, কবিতা আর নৃত্যে ছন্দময় হয়ে ওঠে বকুলতলার আশ্বিনের বিকেল।
ছবি : ওমর ফারুক টিটু